• যোগাযোগ
  • সংবাদ দিন
  • ই-পেপার
    • ঢাকা, বাংলাদেশ

    ছাত্র রাজনীতি: প্রয়োজন নাকি বিভ্রান্তি? 

     dailybangla 
    19th Sep 2025 6:32 pm  |  অনলাইন সংস্করণ

    তামান্না ইসলাম

    শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

    বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি বহুদিন ধরেই বিতর্কের বিষয়। স্বাধীনতার আগে ও পরে ছাত্র আন্দোলন ছিল পরিবর্তনের বড় চালিকাশক্তি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হোক, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হোক—সবখানেই ছাত্রদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই ছাত্র রাজনীতি আজ অনেকাংশে ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। অতীতের সেই আদর্শনিষ্ঠ, দেশপ্রেমিক ছাত্র নেতাদের জায়গায় এসেছে দলীয় প্রভাবিত, ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং সহিংসতায় অভ্যস্ত সংগঠন। তাই আজ প্রশ্ন উঠছে—আধুনিক বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির আর কোনো প্রয়োজন আছে কি? নাকি এটি শুধুই বিভ্রান্তি ও ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে?

    মূলত,সুশিক্ষাই প্রকৃত চেতনার ভিত্তি। ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো—রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করা। কিন্তু সত্যিই কি রাজনীতি শেখার জন্য কোনো ছাত্রকে দলীয় NCP, শিবিরে বা ছাত্রদলে যোগ দিতে হবে? একজন মানুষ যদি সুশিক্ষিত হয়, তবে সে নিজেই রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠবে। শিক্ষা মানুষকে শেখায় প্রশ্ন করতে, যুক্তি খুঁজতে, ভিন্নমতকে সম্মান করতে। আর এভাবেই তৈরি হয় গণতান্ত্রিক মানসিকতা।
    ধর্মীয় অনুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবিকতা, সমাজকল্যাণ—এসব বিষয় শিক্ষার মাধ্যমেই উপলব্ধি করা সম্ভব। মগজ ধোলাই বা জোর করে দলীয় আদর্শ চাপিয়ে দিলে মানুষ অন্ধ অনুসারী হয়, মুক্তচিন্তার ধারক নয়।

    তাহলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা কি!
    বাংলাদেশে অধিকাংশ ছাত্র সংগঠন এখন বড় রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখা হিসেবে কাজ করে। তাদের নিজস্ব কোনো লক্ষ্য বা দর্শন নেই। ফলে তাদের কাজ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে—দলীয় কর্মসূচি পালন,ক্যাম্পাস দখল রাখা,বিরোধীদের দমন,এবং নিজেদের প্রভাব বিস্তার। এর ফলাফল ভয়াবহ। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। মেধাবী ছাত্ররা আতঙ্কে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বাইরে থাকা ছাত্ররা নানা হয়রানির শিকার হয়। এমনকি ভর্তি, পরীক্ষার আসন বণ্টন কিংবা হলে থাকার অধিকার—এসব মৌলিক ক্ষেত্রেও দলীয় প্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে।

    আজকে পুরো একটা প্রজন্ম ব্রেনওয়াশের শিকার। ছাত্র রাজনীতির নামে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে যে ব্রেনওয়াশ প্রক্রিয়া চালানো হয় তা ভয়ঙ্কর। অনেক সময় সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীরা দলীয় আদর্শে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ে যে তারা কোনো সমালোচনা শুনতেই রাজি হয় না। তারা মনে করে—তাদের দলই সর্বশ্রেষ্ঠ, বাকিরা শত্রু। এর ফলে তৈরি হয় সহিংস ও পক্ষপাতদুষ্ট মানসিকতা, যা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের ভবিষ্যতের জন্যও হুমকি।

    বর্তমান শিক্ষাঙ্গনের সহিংসতার বাস্তব চিত্র- আমরা প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় দেখি—বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ, হলে সিট নিয়ে মারামারি, এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। বেশিরভাগ আবাসিক হলে দেখা যায়, ছাত্র সংগঠনের প্রভাবশালী নেতারা আসন বণ্টনে কর্তৃত্ব করে। মেধাবী বা যোগ্য ছাত্ররা সিট পায় না, অথচ দলীয় সমর্থকরা বিনা যোগ্যতায় সিট পেয়ে যায়। অনেক হলে এমনকি “টর্চার সেল” চালু থাকার খবরও শোনা যায়—যেখানে বিরোধী দলীয় ছাত্র বা নিরপেক্ষ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এই অমানবিক সংস্কৃতির ভয়াবহতম উদাহরণ হলো আবরার ফাহাদ হত্যা।২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরে বাংলা হলের সেই আবরার ফাহাদ। শিক্ষাঙ্গনে প্রায়ই দেখা যায়, একটি ছাত্র সংগঠন পুরো ক্যাম্পাস দখল করে রাখে। পোস্টার থেকে শুরু করে ক্যান্টিন, লাইব্রেরি বা সাংস্কৃতিক মঞ্চ—সব জায়গায় তাদের প্রভাব থাকে। বিরোধী ছাত্ররা সেখানে কার্যক্রম চালাতে পারে না। ফলে ক্যাম্পাস পরিণত হয় একমুখী ও ভীতিকর পরিবেশে।

    এসবের সমাধানের পথ কোথায়? ছাত্র রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? হয়তো পুরোপুরি নয়। কারণ রাজনীতি হলো সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু সমাধানের পথ অবশ্যই আছে প্রথমত, শিক্ষাঙ্গনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। ছাত্র সংগঠন থাকতে পারে, তবে তারা যেন দলীয় শাখা না হয়ে নিজেদের লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করে। দ্বিতীয়ত, সুশিক্ষার উপর জোর দেওয়া পাঠ্যক্রমে গণতন্ত্র, নাগরিক দায়িত্ব, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে কার্যকর শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এতে ছাত্ররা রাজনৈতিক সচেতন হবে, তবে অন্ধ অনুসারী নয়।

    তৃতীয়ত, বিকল্প নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ দেওয়া ছাত্ররা বিতর্ক ক্লাব, গবেষণা সংগঠন, সামাজিক স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ কিংবা ক্রীড়া ও সংস্কৃতির মাধ্যমে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করতে পারে। এতে সহিংসতা ছাড়াই তারা সংগঠিত হওয়ার অভিজ্ঞতা পাবে।চতুর্থত, শাস্তির কঠোর প্রয়োগ যারা শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা ঘটাবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় পরিচয় দিয়ে যেন কেউ অপরাধ আড়াল করতে না পারে।

    পঞ্চমত, বিকল্প নেতৃত্বের সুযোগ তৈরি: ছাত্র সংসদ নির্বাচন (ডাকসু, রাকসু,চাকসু,জকসু) নিয়মিত আয়োজন করতে হবে, তবে তা হতে হবে দলীয় প্রভাবমুক্ত। এই নির্বাচনগুলো শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দেবে। বিতর্ক, কুইজ প্রতিযোগিতা, সামাজিক স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের মতো সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে ছাত্রদের নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। এবং মেধাবী ছাত্রদের সামনে আনা নেতৃত্বের জায়গায় শুধু প্রভাবশালীরা নয়, বরং যোগ্য ও মেধাবী ছাত্রদের উঠে আসতে হবে। এজন্য স্বচ্ছ নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জরুরি।

    ছাত্র রাজনীতি নয়, চাই মানবিক প্রজন্ম। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে যুক্তিনির্ভর, মানবিক ও গণতান্ত্রিক প্রজন্ম চাই, তবে প্রথম শর্ত হলো—সুশিক্ষা। শিক্ষা যদি মুক্ত থাকে, তবে ছাত্ররা নিজেরাই বুঝতে শিখবে কোনটা সঠিক, কোনটা ভুল। তখন তাদের অন্ধ অনুসারী হতে হবে না, বরং তারা নিজেরাই হবে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব। ছাত্র রাজনীতি বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিভ্রান্তিকর ও ধ্বংসাত্মক হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি ছাত্রদের চরিত্র নষ্ট করছে, শিক্ষার পরিবেশ কলুষিত করছে এবং জাতির অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এখন সময় এসেছে নতুন করে ভাবার—আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কি আমরা দলীয় যন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, নাকি সুশিক্ষিত, মানবিক ও বিশ্লেষণক্ষম নাগরিক হিসেবে?

    বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন গৌরবের। কিন্তু আজকের ছাত্র রাজনীতি সেই ইতিহাসকে কলুষিত করছে। তাই অতীতের গৌরবের আড়ালে বর্তমানের সংকট ঢেকে রাখা যাবে না। প্রয়োজন পরিবর্তনের। আমাদের মনে রাখতে হবে—রাজনীতি সচেতনতা আসে শিক্ষার মধ্য দিয়ে, জোরপূর্বক ব্রেনওয়াশের মধ্য দিয়ে নয়। তাই সময় এসেছে শিক্ষাঙ্গনকে প্রকৃত অর্থে মুক্ত করার, তরুণদের প্রকৃত শিক্ষা দেওয়ার, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধ অনুসারী নয়, বরং মুক্তচিন্তার ধারক হিসেবে গড়ে তোলার।

    বিআলো/ইমরান

     

    এই বিভাগের আরও খবর
     
    Jugantor Logo
    ফজর ৫:০৫
    জোহর ১১:৪৬
    আসর ৪:০৮
    মাগরিব ৫:১১
    ইশা ৬:২৬
    সূর্যাস্ত: ৫:১১ সূর্যোদয় : ৬:২১

    আর্কাইভ

    September 2025
    M T W T F S S
    1234567
    891011121314
    15161718192021
    22232425262728
    2930