জলবায়ু সংকটে বিপন্ন উপকূল, বাড়ছে দুর্যোগ ও জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের ঢল
মুশফিকুর রহমান, খুলনা: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা ও পুনরাবৃত্তি ক্রমেই বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, বন্যা ও খরার মতো দুর্যোগে প্রতিবছর হাজারো পরিবার হারাচ্ছে ঘরবাড়ি ও জীবিকার শেষ সম্বল। এর ধারাবাহিকতায় দেশে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গবেষণা সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশে কোটি কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে সংকট নিয়ে আলোচনা হলেও বাস্তবভিত্তিক কার্যকর সমাধান এখনও পর্যাপ্ত নয়। এই প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলা ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে আগামী ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশ-২০২৫’। দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনে দেশি-বিদেশি পরিবেশবিদ, গবেষক, নীতিনির্ধারক ও সামাজিক আন্দোলনের নেতারা অংশগ্রহণ করবেন।
সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক ও ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর সদস্যসচিব শরীফ জামিল বলেন, জলবায়ু বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে পরিবেশগত ন্যায্যতার আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করাই এই আয়োজনের মূল লক্ষ্য। তিনি জানান, ১৪টি দেশের অন্তত ১৫ জন খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞসহ সারা দেশ থেকে সহস্রাধিক প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশ নেবেন।
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, গত তিন দশকে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এর অন্যতম প্রধান কারণ। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় জনপদগুলোতে স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে নারী, শিশু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। জীবিকা সংকটের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
দুর্যোগের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে কৃষি ও মৎস্যনির্ভর পেশা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। লবণাক্ততার বিস্তার, নদ-নদী ও জলাশয় দখল এবং দূষণের কারণে বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। নিরুপায় হয়ে কেউ রাজধানী ঢাকা, কেউ চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রায় ৬০ শতাংশ ঢাকায়, ২০ শতাংশ চট্টগ্রাম নগরে এবং বাকি অংশ দেশের অন্যান্য জেলায় আশ্রয় নিচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর গবেষকদের করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেশের ২২টি নিম্নাঞ্চলীয় শহরের জলবায়ু ঝুঁকির চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু ঝুঁকির প্রভাব শুধু অবকাঠামো বা অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎকে গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের তথ্যমতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হতে পারে। অন্যদিকে উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, একই সময়ে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা পৌঁছাতে পারে প্রায় দুই কোটি ৬০ লাখে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়, অস্বাভাবিক জোয়ারের প্লাবন, নদীভাঙন ও লবণাক্ততার কারণে উপকূল থেকে শহরমুখী মানুষের ঢল নামছে, যারা শহরের বস্তিতে অমানবিক জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। ঢাকার বস্তিবাসীদের একটি বড় অংশই পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার।
জলবায়ু সচেতনতা ও সুন্দরবন-উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক সাংবাদিক শুভ্র শচীন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে উপকূলীয় অঞ্চলে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ভেঙে পড়েছে। ঘন ঘন দুর্যোগ, তাপমাত্রার চরম ওঠানামা, অসময়ে বন্যা ও খরা এবং পানির স্তর নেমে যাওয়ার মতো সংকট মানুষের জীবনকে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে ফেলছে। শুষ্ক মৌসুমে নিরাপদ পানির সংকট, নদীভাঙন ও লবণাক্ততার বিস্তার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডই জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বন উজাড়, জলাভূমি ভরাট এবং অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। চলতি বছরে তীব্র তাপপ্রবাহে দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা।
পরিবেশবিদরা মনে করছেন, এই সংকট থেকে উত্তরণে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, প্রকৃতি সংরক্ষণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যকর অভিযোজন কৌশল বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। সময়মতো উদ্যোগ না নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত আরও গভীর ও ভয়াবহ সংকটে রূপ নিতে পারে।
বিআলো/ইমরান



