জীবন বনাম বিলাসিতা: কেন পানির চেয়ে ডায়মন্ড দামী?
মো. তরিকুল ইসলাম (মোস্তফা),বাউফল (পটুয়াখালী): মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য উপাদানগুলোর তালিকায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পানি। ‘পানির অপর নাম জীবন’—এই সত্যটি আমরা শৈশব থেকেই জেনে এসেছি। অথচ বাজারমূল্যের দিক থেকে দেখা যায় এক বিস্ময়কর বৈপরীত্য। যে পানি ছাড়া এক মুহূর্তও জীবন সম্ভব নয়, সেই পানির দাম নামমাত্র; আর যে পাথর জীবনধারণে কোনো ভূমিকা রাখে না, সেই হীরা বা ডায়মন্ডের দাম আকাশচুম্বী। অর্থনীতির এই বৈপরীত্যপূর্ণ বাস্তবতাকেই বলা হয় ‘ভ্যালু প্যারাডক্স’।
বাউফল মহিলা ডিগ্রি কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. অহিদুজ্জামান সুপন বলেন, “এই প্রশ্নটি অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথের সময় থেকেই আলোচিত। কেন অপরিহার্য পানির চেয়ে অপ্রয়োজনীয় হীরা বেশি দামী—এর উত্তর লুকিয়ে আছে চাহিদা ও দুষ্প্রাপ্যতার তত্ত্বে।”
অর্থনীতিবিদদের মতে, পানির ‘ব্যবহারিক মূল্য’ (Use Value) অত্যন্ত বেশি হলেও এর ‘বিনিময় মূল্য’ (Exchange Value) তুলনামূলকভাবে কম—কারণ অধিকাংশ স্থানে পানি সহজলভ্য। বিপরীতে, ডায়মন্ড প্রকৃতিতে অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। কোটি কোটি বছর ধরে প্রচণ্ড তাপ ও চাপে তৈরি হওয়া এই পাথর পাওয়া কঠিন হওয়ায় এর দাম বেশি।
ডায়মন্ডের উচ্চমূল্যে কেবল প্রকৃতি নয়, মানুষের তৈরি বিপণন কৌশলও বড় ভূমিকা রেখেছে। বিংশ শতাব্দীতে ‘ডায়মন্ড ইজ ফরএভার’—স্লোগানের মাধ্যমে হীরাকে ভালোবাসা, সামাজিক মর্যাদা ও আভিজাত্যের প্রতীকে রূপ দেয়া হয়। ফলে এটি শুধু অলংকার নয়, বরং সামাজিক অবস্থান ও সফলতার প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়।
বাউফল পৌর জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি স্বর্ণ ব্যবসায়ী লিটু সাহা বলেন, “পানি জীবনধারণের প্রধান উপাদান হলেও এখনো অধিকাংশ এলাকায় পানির প্রাপ্যতা রয়েছে। অন্যদিকে ডায়মন্ডের দুষ্প্রাপ্যতাই একে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে গেছে।”
তবে চিত্র বদলে যাচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জলবায়ু পরিবর্তন, নদী-নালা দখল ও দূষণের কারণে বিশুদ্ধ পানির উৎস দ্রুত কমছে। অনেক দেশে বোতলজাত পানির দাম জ্বালানি তেলের সমপর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতের যুদ্ধ খনিজ তেলের জন্য নয়, বরং পানি নিয়ে হতে পারে।
বাউফল প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অহিদুজ্জামান ডিউক বলেন, “মরুভূমিতে তৃষ্ণায় কাতর একজন পথিকের কাছে এক বস্তা হীরার চেয়ে এক গ্লাস পানির মূল্য অনেক বেশি। সংকটের মুহূর্তে পানির ব্যবহারিক মূল্যই সর্বোচ্চ।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা হয়তো এখনো হীরাকেই দামী ভাবছি। কিন্তু প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকায় এমন দিন দূরে নয়, যেদিন মানুষ বুঝবে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন হীরা নয়—বরং এক ফোঁটা বিশুদ্ধ পানি।”
বিআলো/ইমরান



