জুলাই সনদ: ঐকমত্য না অনিশ্চয়তার সনদ?
সম্পাদকীয়: বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘জুলাই সনদ ২০২৫’ নিঃসন্দেহে এক নতুন অধ্যায়। জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোটের স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ঘোষিত এই সনদ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কিন্তু এই স্বাক্ষরের মধ্যেই কি নতুন বাংলাদেশের বাস্তব সূচনা হলো- নাকি এটি কেবল আরেকটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির কাগুজে দলিল?
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বলেন, “জুলাই সনদ দিয়েই আমাদের নবজন্ম হলো।” কিন্তু বাস্তবতা হলো- এই নবজন্মের কাঠামো এখনো অনির্ধারিত। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাম দলগুলোর অনুপস্থিতি প্রমাণ করেছে, সব পক্ষ এই ‘ঐকমত্যে’ আস্থা রাখতে পারেনি।
মূল সংকট সনদের বাস্তবায়ন কাঠামো ও আইনি ভিত্তি নিয়ে। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ুমের মতে, গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ইস্যুতে সনদটি নীরব। ফলে এটি এখন রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বেশি কিছু নয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গণভোট আয়োজনের কথা বললেও সময়, প্রক্রিয়া ও রূপরেখা এখনো স্পষ্ট নয়। বিএনপি নির্বাচনের দিনে গণভোট চায়, জামায়াত ও এনসিপি আগে- কিন্তু সরকার নীরব।
এদিকে জুলাই যোদ্ধা ও শহীদদের তালিকা নিয়েও প্রশ্ন বাড়ছে। যশোরের অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন ঘটনায় নিহতদের অনেককেই শহীদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করায় সমালোচনা তীব্র। সরকারের দাবি, যাচাই চলছে- তবে প্রাথমিক তালিকা তৈরির স্বচ্ছতা নিয়েও সন্দেহ রয়ে গেছে।
সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু ছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়ার প্রস্তাব, যা বাম দলগুলো ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হিসেবে আখ্যা দেয়। পরে কমিশন প্রস্তাব সংশোধন করলেও সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও জাসদ স্বাক্ষর করেনি। ফলে শুরুতেই ঐকমত্যে ফাটল ধরে।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের দিন পুলিশের সঙ্গে ‘জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে সংঘর্ষ প্রমাণ করেছে, পরিবর্তনের স্বপ্ন এখনো উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তার আবরণে ঢাকা।
শেষ কথা-
জুলাই সনদ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। কিন্তু এই সূচনা একই সঙ্গে আশাবাদ ও আশঙ্কার মিশেল।
সনদটি একদিকে যেমন গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতীক, অন্যদিকে এর আইনি কাঠামো, বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাব সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
যদি সরকার ও কমিশন দ্রুত স্পষ্ট রূপরেখা দিতে না পারে, তবে এই সনদও হয়তো ইতিহাসের আরেকটি অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হবে।
তবুও, একটি বিষয় অনস্বীকার্য- বাংলাদেশে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা আজ আর কোনো ঘোষণায় থেমে নেই; এটি এখন জনগণের রক্তে লেখা এক বাস্তবতার নাম।
বিআলো/শিলি



