জুলাই হত্যাকাণ্ড: রায়েরবাজারের গণকবরে ১১৪ লাশ — রাষ্ট্রীয় নাকি সংগঠিত নির্যাতন?
নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে ১১৪ জন নিহত ছাত্র-যুবকের মরদেহ একসঙ্গে গণকবরে শায়িত। তাদের পরিচয় অজানা, ইতিহাসে তারা নিরব। মৃত্যুর কারণ অজানা, অথচ আন্দোলনের পটভূমি স্পষ্ট—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এমন এক প্রেক্ষাপটে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের রায় নতুন করে আলোচনায় এনেছে এই গণকবরের ইতিহাসকে। পুলিশের আবেদনের ভিত্তিতে আদালত ১১৪ মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছেন। উদ্দেশ্য—ময়নাতদন্ত, ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ এবং মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান।
কী ছিল সেই আন্দোলন?
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থাকে ঘিরে বিগত জুলাই-আগস্ট মাস ধরে রাজধানীজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। উচ্চশিক্ষায় কোটা সংস্কার, বেতন বৈষম্য, এবং নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ভিত্তিক সুবিধা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামে। প্রথমে শান্তিপূর্ণ হলেও সময়ের সাথে সাথে দমন-পীড়ন শুরু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, আন্দোলনের সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিদের গুলিবর্ষণ, রাতের বেলা হোস্টেলে অভিযান, এবং আটককৃতদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক আন্দোলনকারীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আর ফেরত আনা হয়নি।
কারা এই ১১৪ জন?
মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক মো. মাহিদুল ইসলামের আবেদনে বলা হয়, রায়েরবাজার কবরস্থানে ‘অশনাক্ত শহীদ’ হিসেবে ১১৪ মরদেহ দাফন করা হয়েছে। এদের মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয়ই রয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই মরদেহগুলো কোথা থেকে, কিভাবে, কার মাধ্যমে কবরস্থানে পৌঁছালো? হাসপাতাল নাকি পুলিশ হেফাজত—কে করেছিল দাফনের দায়িত্ব? সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর এখনো স্পষ্ট নয়।
রাষ্ট্রীয় নিরবতা ও তথ্য গোপনের অভিযোগ
নিহতদের আত্মীয়স্বজনের কেউ এখনো এগিয়ে আসেনি বা তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না—এটাই প্রশাসনের দাবি। তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার মতে, পরিবারগুলো হয়তো ভয়ভীতির কারণে প্রকাশ্যে আসতে পারছে না।
তাদের দাবি, রাষ্ট্র এই ঘটনায় নীরব থেকেছে, এমনকি গণমাধ্যমেও পুরো বিষয়টি দীর্ঘ সময় আলোচনার বাইরে ছিল। হঠাৎ করে আদালতের এই আদেশ যেন চাপা পড়া সত্যকে টেনে আনছে জনসমক্ষে।
ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ
আদালতের নির্দেশে মরদেহ উত্তোলনের মাধ্যমে ময়নাতদন্ত, ডিএনএ সংগ্রহ এবং পরিচয় শনাক্তের উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দীর্ঘদিন কবরস্থ থাকা মরদেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরিচয় নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
তবে এটিই শেষ সুযোগ—নিহতদের নাম, পরিচয় এবং মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানার। বিচার না হোক, অন্তত ইতিহাসে যেন তারা ফিরে পায় নিজেদের পরিচয়।
প্রশ্ন রয়ে যায়…
আন্দোলনে নিহতদের মধ্যে কারা ছিল এই ১১৪ জন?
মৃত্যুর কারণ গুলি, নির্যাতন নাকি অন্য কিছু?
দায় কার—রাষ্ট্রের, না অন্য কোনো গোপন শক্তির?
আর কত পরিবার অজানা কবরের সামনে অপেক্ষায় থাকবে একটি খবরের জন্য?
বিআলো/তুরাগ