টাইগার আইটি নিয়ে অভিযোগের পাহাড়
নিজস্ব প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর টেন্ডার ছাড়াই এক দশকের বেশি সময় কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ছাড়াই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) আরএফআইডি ভেহিক্যাল নাম্বার প্লেট এবং ডিজিটাল স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে টাইগার আইটি নামে একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত হলেও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর প্রভাবে সক্ষমতা থাকলেও বিআরটিএর আরএফআইডি স্মার্ট কার্ড প্রকল্পে টাইগার আইটির সঙ্গে প্রতিযোগিতার সাহস দেখায়নি কোনো দেশীয় প্রতিষ্ঠান।
নির্বাচন কমিশনের স্মার্ট কার্ড মুদ্রণ সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পেও দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে টাইগার আইটির বিরুদ্ধে। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটিকে ২০১৯ সালে সাড়ে ৯ বছরের জন্য এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানকে সাড়ে ছয় বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত হওয়া ২০১৯ সালের আগস্টে টাইগার আইটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে বিআরটিএ। এটি এক ধরনের আইওয়াশ বলা যায়। নতুন টেন্ডার করে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সকে নিয়োগ দিলেও চুক্তির মেয়াদ ২০২১ এর জুন পর্যন্ত স্মার্ট কার্ডের সার্ভার এবং ডেটাবেজ হস্তান্তরে গড়িমসি করে।
চুক্তি বাতিল হলেও বিআরটিএর প্রকল্প থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা মুনাফা করেছে উল্লেখ করা হয় টাইগার আইটির বার্ষিক অডিট প্রতিবেদনে। জানা গেছে, বিআরটিএর একদল অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে টাইগার আইটি।
বর্তমানে বিআরটিএর স্মার্ট কার্ডসহ অন্যান্য সরকারি প্রকল্পে নতুন করে যুক্ত হতে তুসাকা গ্রুপের মাধ্যমে চেষ্টা অব্যাহত রাখেন তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর স্ত্রী শাহনাজ সিদ্দিকী। তুসাকা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পেন্টাগ্লোবাল, নভোটেল, কম্পিউটার সার্ভিস লিমিটেড (সিএসএল), আইবিসিএস-প্রাইমেক্স। টাইগার আইটি কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার পরে পেন্টাগ্লোবাল, সিএসএল, আইবিসিএস-প্রাইমেক্সের নামে যৌথভাবে প্রকল্প জমা দেওয়া হয়। এভাবে পুরো প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখেন টাইগার আইটির জিয়াউর রহমান।
কালো তালিকাভুক্ত হিসেবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কোনো টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে না টাইগার আইটি এবং চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানের ২০২৫ সাল পর্যন্ত কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক টেন্ডারে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা নেই।
সূত্র বলছে, চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকায় ওরাকল, সিসকোর মতো মার্কিন প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটির সঙ্গে কাজ করছে না। নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে কাজ করার জন্য ইউরোপে কয়েকটি শেল কোম্পানি (মূলত মুদ্রা পাচারের লক্ষ্যে) খুলেছেন জিয়াউর রহমান। নির্বাচন কমিশন, ঢাকা ওয়াসা, পাসপোর্ট অধিদফতর, এনআইডি অনুবিভাগের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে বাংলাদেশে আইবিসিএস-প্রাইমেক্সে নামে ছদ্মবেশী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কয়েকশ কোটি টাকার কাজ করেছে টাইগার আইটি, সবকিছুই অডিট ও মূল্যায়নের বাইরে।
ক্ষমতার বলয়ে থেকে প্রকল্প ধরতে প্রতিষ্ঠানটিতে এএইচএম রাশেদ সরোয়ার নামে একজনকে এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) পদে বসান বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত উদ্যোক্তা জিয়া।
রাশেদুলের শ্বশুর আওয়ামী লীগের কুষ্টিয়া জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি। গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর রাশেদুল সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি জমান। মার্কিন পাসপোর্টধারী জিয়া দুবাই থেকেই বাংলাদেশের সব প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কালো তালিকাভুক্ত হলেও হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর ছায়ায় বিআরটিএর প্রকল্পে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে টাইগার আইটি। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর অফিসের (পিএমও) দাপটে কোনো বিআরটিএ অফিসার মুখ খোলেনি গত ১৩ বছর ধরে। জাল, অবৈধ ও ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স ঠেকাতে ২০১১ সালে ইলেকট্রনিক চিপযুক্ত ডিজিটাল স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রবর্তন করে। শুরু থেকেই বিআরটিএ প্রকল্পে যুক্ত টাইগার আইটি।
জানা গেছে, কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার পরে নতুন ভেন্ডরকে (মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স) সার্ভারসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি হস্তান্তর করার অনুরোধ করা হলেও বছরের পর বছর ধরে প্রকল্প ধরে রাখতে বিআরটিএর কোনো অনুরোধে সাড়া দেয়নি টাইগার আইটি।
বিআরটিএর প্রকল্পে প্রতিযোগিতা ছাড়াই কাজ করা প্রসঙ্গে টাইগার আইটির চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানের মন্তব্যের জন্য কয়েকবার খুদে বার্তা ও ফোন করা হলেও উত্তর মেলেনি। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট নিয়ে বর্তমানে দুবাইয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন জিয়া।
টাইগার আইটির মতো কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের হাতে দেশের নাগরিকদের তথ্য থাকাটাকে অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টারের (এপনিক) নির্বাহী কমিটির সদস্য সুমন আহমেদ সাবির। তিনি বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেশের ১৮ কোটি নাগরিকের তথ্য থাকাটা অপরাধ নয়, তবে তারা কোনো ধরনের জবাবদিহিতার মধ্যে না থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে। একটি প্রতিষ্ঠান এক দশকের বেশি সময় ধরে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ছাড়াই কাজ করছে, এটি উন্নত বিশে^ অস্বাভাবিক হলেও আমাদের দেশে এ ধরনের প্র্যাকটিস অনেক দিন ধরে হয়ে আসছে ক্ষমতার বলয় থেকে। যেকোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় কাজ দেওয়া উচিত, তা হলে সরকারি অর্থের অপচয় কমবে।
প্রযুক্তি খাতের শীর্ষ বণিক সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, বিআরটিএর প্ল্যাটফর্ম ম্যানেজের জন্য অনেক দেশি প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কাজ করতে সক্ষম। সেখানে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানকে ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথডে (সরাসরি কেনাকাটা) যুক্ত করাটা অমূলক। তিনি আরও বলেন, এখানে জবাবদিহিতা না থাকার কারণে তথ্যফাঁস কিংবা অন্য টেকনিক্যাল সমস্যা হলে আইনের আওতায় আনা কঠিন হবে। কারণ একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকা পড়ে আছে বিআরটিএর মতো একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান।
২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি টেন্ডার ছাড়াই ৪ লাখ ডিজিটাল স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স কিনতে ১৮ দশমিক ৯ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেন হাসিনার মন্ত্রিসভা। প্রতিটি লাইসেন্স প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে কেনা হয় উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে। প্রতিটি স্মার্ট কার্ডের বাজারমূল্য ৫০ টাকা হলেও প্রকল্পে প্রায় ৫০০ টাকা (৪৭২ দশমিক ৬০ টাকা) করে কেনা হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যুর পরিসংখ্যান ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনা করে প্রতি বছর গড়ে ৩ লাখ স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রয়োজন।