তামাকের ক্ষতি হ্রাসে প্রয়োজন প্রগতিশীল নীতিমালা
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ হার্ম রিডাকশন ফাউন্ডেশনের সেমিনার
নিজস্ব প্রতিবেদক: তামাকের ক্ষতি হ্রাসে বাস্তবসম্মত নীতি গ্রহণ করে সফলতা পেয়েছে নিউজিল্যান্ডসহ অনেক দেশ। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এ ধরনের কোনো নীতি বা কৌশল নেই। ফলে কঠোর বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও যথাযথ বাস্তবায়ন ও অনুমোদনের অভাবে তামাক এখনো বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর ও বাস্তবসম্মত তামাক ক্ষতি হ্রাস নীতি প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
আজ (সোমবার) ঢাকার হোটেল রেনেসাঁয় আয়োজিত “Policy for Progress: Towards Harm Reduction 2.0” শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এ আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ হার্ম রিডাকশন ফাউন্ডেশন। ওয়ার্ল্ড মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ডা. ডেলন হিউম্যান বলেন, নিউজিল্যান্ড বাস্তবভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিক কৌশল গ্রহণ করে সফলভাবে ধূমপান কমিয়ে আনতে পেরেছে।
তিনি বলেন, সেখানে ভেপিংয়ের মতো বিকল্পকে স্বীকৃতি দিয়ে মানুষকে ধূমপান ছাড়ার বাস্তব পথ দেখানো হয়েছে। এর ফলে মাত্র কয়েক বছরে দেশটিতে ধূমপানের হার প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে।
‘A Tale of Two Nations: Bangladesh Versus New Zealand’ শীর্ষক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তিনি জানান, ২০১৫ সালে নিউজিল্যান্ডে প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীর হার ছিল ১৩.৩ শতাংশ, যা এখন কমে ৬.৯ শতাংশে নেমেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে এই হার ২৩ শতাংশ থেকে কমে ১৭ শতাংশ হয়েছে। দুই দেশের পার্থক্যের মূল কারণ হলো— নিউজিল্যান্ডে ক্ষতি হ্রাস নীতিমালা কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে তা করা হয়নি, যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে প্রয়োজন বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশ হার্ম রিডাকশন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ও চেয়ারম্যান ড. মো. শরিফুল ইসলাম দুলু বলেন, নিউজিল্যান্ডের সাফল্যের মূল কারণ তাদের বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ।
তিনি বলেন, “দেশটি ভেপিংয়ের মতো বিকল্পকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দিয়ে ধূমপায়ীদের ধূমপান ছাড়ার জন্য কার্যকর নীতি প্রণয়ন করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “বৈজ্ঞানিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ক্ষতি হ্রাস কৌশল অনুসরণ করে না। বরং ই-সিগারেট আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করা হয়েছে। এতে অবৈধ বাণিজ্য বাড়ছে, সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে এবং ভোক্তারা বিকল্প পণ্যের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
তার ভাষায়, “বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে ধূমপায়ীর হার ৩৪.১ শতাংশ, যা নিউজিল্যান্ডের তুলনায় চার গুণ বেশি। প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন— দেশের মোট মৃত্যুর ২১.৯ শতাংশ।”
‘নিষেধাজ্ঞা নয়, প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ’ — টিমোথি অ্যান্ড্রুস
অনলাইনে যুক্ত হয়ে থোলোস ফাউন্ডেশনের কনজিউমার ইস্যুজের ডিরেক্টর টিমোথি অ্যান্ড্রুস বলেন, নিষেধাজ্ঞা ও কঠোরতা তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর সমাধান নয়।
তিনি বলেন, “ব্রাজিলসহ অনেক দেশে এটি প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের গবেষণা ‘Prohibition Does Not Work’-এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।”
তিনি সুইডেনের উদাহরণ টেনে বলেন, “গত তিন দশকে দেশটিতে বহু মানুষ ধূমপান ছেড়ে স্নাস নামক ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্যে অভ্যস্ত হয়েছেন। এটি কম ক্ষতিকর ও সাশ্রয়ী হওয়ায় দেশটি এ ধরনের পণ্যের ওপর করও কমিয়েছে। ফলে ধূমপানজনিত মৃত্যু ও রোগের হার নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে।”
‘নীতিমালা না থাকায় বাড়ছে অবৈধ ভেপ বাজার’
বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন জামান বলেন, “ধূমপানের ক্ষতি হ্রাসে কার্যকর বিকল্প হিসেবে অনেক দেশে ভেপ জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে এর আমদানি নিষিদ্ধ।”
তিনি জানান, নিষেধাজ্ঞার পরও অবৈধভাবে দেশে বিপুল পরিমাণ ভেপ প্রবেশ করছে, যার ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে এবং মান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।
তার মতে, বৈধ আমদানি ও বিক্রির সুযোগ দিয়ে একটি বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন করা গেলে ধূমপানের হার কমানো ও বৈধ ব্যবসায়ীদের জীবিকা সুরক্ষায় সহায়ক হবে।
‘বাস্তবসম্মত নীতি প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি’
সেমিনারের সমাপনী বক্তব্যে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের সিনিয়র ম্যানেজার হাসনাত আলম বলেন, “তামাকজনিত ক্ষতি হ্রাস কৌশল গ্রহণ ও এ বিষয়ে একটি আলাদা নীতি প্রণয়ন করা অপরিহার্য।”
তিনি যোগ করেন, “ক্ষতি হ্রাসকারী পণ্য নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে, এগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। এতে বাজারে স্বচ্ছতা আসবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীদের জন্য কম ক্ষতিকর বিকল্প তৈরি হবে।
তামাকের ক্ষতি হ্রাসে নিষেধাজ্ঞা নয়, প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গঠিত একটি প্রগতিশীল ও বাস্তবমুখী নীতি— যা ধূমপায়ী, ভোক্তা, ব্যবসায়ী এবং রাষ্ট্র, সকলের জন্যই লাভজনক হতে পারে।
বিআলো/এফএইচএস