তেল যেভাবে রাশিয়া-চীন ও ভারতকে আরও কাছাকাছি এনেছে
আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: চীনের তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত দুদিনব্যাপী সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক সংহতির এক বিরল প্রদর্শনী। একই সঙ্গে এই বৈঠক পুতিনের জন্য রাশিয়ার প্রধান দুই তেল ক্রয়কারী দেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সূত্র: বিবিসি
২০২২ সালে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার সাথে সব ধরনের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করে পশ্চিমা দেশগুলো। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাশিয়া তার তেলের দাম কমিয়ে দেয়। সস্তা তেল কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠে ভারত ও চীন। কিন্তু সম্পর্ক কেবল তেল কেনায় আটকে থাকেনি। বেইজিং, নয়াদিল্লি ও মস্কো অন্যান্য ক্ষেত্রেও সম্পর্ক আরও গভীর করেছে।
ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের কারণে সেই শুরু থেকেই রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর রুশ তেল কেনায় শাস্তি হিসেবে মস্কোর বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর সম্প্রতি অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে ওয়াশিংটন। যা রাশিয়া, চীন ও ভারতকে আরও কাছাকাছি এনেছে এবং এই তিন দেশকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিন্ন প্রতিপক্ষ বিবেচিত হচ্ছে।
রাশিয়া থেকে তেল কেনায় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শুল্কের মুখোমুখি হয়েছে ভারত। চীন এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে রাশিয়ার তেল কেনার কারণে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা এবং কঠোর শুল্ক এড়ানো যায়।
এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার পুতিন, মোদি ও জিনপিং চীনের তিয়ানজিনে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে এক টেবিলে মিলিত হন। এই আঞ্চলিক ফোরামের লক্ষ্য হলো পশ্চিমা বিশ্বের বিকল্প একটি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা। বিশ্লেষকদের মতে, এটা আমেরিকার প্রভাবের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে এই শীর্ষ সম্মেলন এশিয়ার এই তিন শক্তিশালী রাষ্ট্রপ্রধান নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও মজবুত করার সুযোগ পেয়েছে।
রাশিয়ার নতুন ভরসাস্থল-
নিজেদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার ভারত ও চীনের সঙ্গে আরও ব্যবসা করার বড় সুযোগ রাশিয়ার রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলে মস্কোর অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এই দুই দেশ।
গত বছর চীন রাশিয়া থেকে রেকর্ড ১০ কোটিরও বেশি টন ক্রুড অয়েল আমদানি করেছে, যা তার মোট জ্বালানি আমদানির প্রায় ২০ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২২ সালের পর ভারতে রাশিয়ার তেল রফতানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে রাশিয়া যাতে জ্বালানি রফতানি করে তার বেশিরভাগটাই হয় চীন ও ভারতে।
বর্তমানে রাশিয়ার বাজেট তার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে তেল ও গ্যাস রফতানি থেকে। আর এই আয় থেকেই দেশটির চলমান যুদ্ধের ব্যয় সংকুলান হয়। সরকারি নীতি বিশেষজ্ঞ মান্দার ওক বলছেন, মস্কো যদি চীন ও ভারতের সঙ্গে আরও বাণিজ্য নিশ্চিত করতে তেলের দাম আরও ছাড় দেয়, সেটা অবাক করার মতো ব্যাপার হবে না।
অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওক আরও বলেন, বিশেষ করে ভারতের ক্ষেত্রে এটা আরও গুরুত্বপূর্ণ, যাতে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পিছু হটতে না বাধ্য হয়।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে তেলের সরবরাহ বিপর্যস্ত হলে ভারত রাশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প বাজারে পরিণত হয়েছে। এতে ভারত সস্তা জ্বালানির সুবিধাও পেয়েছে। এখন ভারতের রাশিয়া থেকে আরও বেশি তেল কেনার সম্ভাবনা রয়েছে, যদিও ওয়াশিংটন এ নিয়ে নিন্দা জানিয়ে আসছে।
গত সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) চীনের তিয়ানজিনে এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার ইঙ্গিত দিয়ে মোদি বলেন, ‘আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে হেঁটেছি, যা দুই দেশের সম্পর্কের প্রতি তার প্রতিশ্রুতিকে তুলে ধরে। দিল্লির কর্মকর্তারাও বলেছেন, তারা সেই দেশ থেকেই জ্বালানি কিনবে, যেখানে সবচেয়ে ভালো দামে পাওয়া যাবে।’
রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে ট্রাম্প প্রশাসনের দিল্লির ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার পর ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। নয়াদিল্লি হোয়াইট হাউসের এই সিদ্ধান্তকে ‘অন্যায্য’ বলে আখ্যা দেয়।
মোদির রাজনৈতিক লাভ-
প্রধানমন্ত্রী মোদির জন্য এই পদক্ষেপটি ঘরোয়া রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অধ্যাপক ওক বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে, মোদির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করা লাভজনক। কারণ এটি একটি বার্তা দেয় যে ভারত ট্রাম্প প্রশাসনের চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না।’
অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়ার তেল কেনা ভারতের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। কারণ দেশটি বিদেশি জ্বালানির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এক সময় মধ্যপ্রাচ্য ছিল ভারতের প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারত সস্তা রাশিয়ান তেলের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ভারতের তেল পরিশোধক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন রাশিয়ার তেল থেকে লাভবান হচ্ছে, কারণ এটি মধ্যপ্রাচ্যের বিকল্পগুলোর চেয়ে সস্তা। বাণিজ্যনীতি বিশেষজ্ঞ পিটার ড্রেপার বলেন, সম্মেলনে আসা নেতাদের মধ্যে চীনও তেল সরবরাহ নিশ্চিত করতে আগ্রহী, যেহেতু রাশিয়া থেকে তাদের তেল কেনার পরিমাণও বেড়েছে।
মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) রাশিয়া ও চীনের গ্যাস করপোরেশনগুলো চীনে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির একটি চুক্তি করেছে। তবে অধ্যাপক ড্রেপার বলেন, যদি পুতিন ভারতের সঙ্গে আরও বেশি তেল বিক্রির চুক্তি করতে পারেন, তাহলে রাশিয়া ও চীনের জন্য একই ধরনের ছাড় নাও দিতে পারে।
চীনের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ-
ড্রেপার বলেন, কেবল বাণিজ্য নয়, বরং চীনের মূল লক্ষ্য এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা। এই ফোরামে চীনের পাশে রয়েছে পাকিস্তান, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ, যেগুলো ট্রাম্পের শুল্কনীতির শিকার হয়েছে। ড্রেপার বলেন, চীন বহুদিন ধরেই একটি ‘মাল্টি-পোলার’ বিশ্বব্যবস্থা চায়, যেখানে একক কোনো দেশের একচেটিয়া আধিপত্য থাকবে না।
অধ্যাপক ওক বলেন, নিজেদের দীর্ঘদিনের ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন ভুলে এবারের এসসিও সম্মেলন তিনটি দেশকে আরও কাছাকাছি এনেছে। বর্তমানে মার্কিন শুল্কারোপের অর্থনৈতিক হুমকির মুখে তারা একসঙ্গে কাজ করার বৃহৎ স্বার্থ খুঁজে পেয়েছে।
বিআলো/শিলি