থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘর্ষ; সীমান্ত উত্তেজনা নাকি ধোঁয়া তুলে অপরাধ ঢাকার অপচেষ্টা?
সীমান্তের অন্ধকারে জ্বলছে ষড়যন্ত্রের আগুন
থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে সংঘর্ষ কেন?
এই উত্তেজনার পেছনে কী আছে?
ইবনে ফরহাদ তুরাগ: শুরুটা কেবল গোলাগুলির নয়—এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত অপরাধপ্রবণ অপারেশন। থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে সম্প্রতি সংঘটিত সশস্ত্র সহিংসতা এখন আর কেবল দুই দেশের পুরোনো সীমান্ত বিরোধ নয়—এটা হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র, সামরিক মাফিয়া, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের সমন্বিত কেন্দ্রস্থল।
সম্প্রতি, ১৮ জুলাই সকাল থেকে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার ছয়টি সীমান্ত পয়েন্টে গোলাগুলি ও রকেট হামলা শুরু হয়। এতে অন্তত ১২ জন থাই নাগরিক নিহত এবং অনেকে আহত হন। থাই বাহিনী পাল্টা জবাবে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দিয়ে কম্বোডিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালায়।

কিন্তু তদন্তে উঠে এসেছে—এটি ছিল পরিকল্পিত উত্তেজনা, যার পেছনে ছিল দুর্নীতিবাজ সামরিক কর্মকর্তাদের চোরাচালান স্বার্থ, রাজনৈতিক বিভাজনকে সুযোগে পরিণত করার চক্রান্ত এবং সীমান্ত বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তারের অপরাধমূলক প্রচেষ্টা।
একটি বিস্ফোরণ, একটি সংকেত: প্রতিশোধের নামে অপারেশন চালায় কারা?
১৭ জুলাই রাতে এক থাই সেনা ল্যান্ডমাইনে পা হারান এবং আরও তিনজন আহত হন। থাইল্যান্ড একে ‘কম্বোডিয়ার ঘৃণ্য মাইন অপারেশন’ বলে ঘোষণা করে। অথচ স্থানীয় সীমান্ত পুলিশ জানায়, এলাকাটি ১৯৮০ দশকের কম্বোডিয়ান গৃহযুদ্ধের সময়কার পরিত্যক্ত যুদ্ধক্ষেত্র। সেখানে নতুন বিস্ফোরক থাকার সুযোগ কম।
বিশ্লেষণে দেখা যায়—এটি ছিল একটি “সিগন্যাল বিস্ফোরণ”। নিরাপত্তা সূত্র দাবি করছে, থাই সামরিক বাহিনীর একটি অংশ নিজেরাই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সীমান্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করে, যাতে সীমান্ত বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ও রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের পথ তৈরি হয়।
ফাঁস হওয়া ফোনালাপ: রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা নাকি অপরাধমূলক রাষ্ট্রদ্রোহিতা?
এ ঘটনার মাত্র কয়েকদিন আগে থাই প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার একটি গোপন ফোনালাপ ফাঁস হয়, যেখানে তিনি কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করেন এবং নিজ দেশের সেনাবাহিনীকে দুর্বল বলেও অভিযোগ করেন।
এই ফোনালাপ রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা লঙ্ঘনের পাশাপাশি জাতীয় মর্যাদাবিরোধী এক ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর পরপরই থাই সেনাবাহিনীর একটি অংশ এবং বিরোধী দল যৌথভাবে সরকারের পতন ঘটায়। প্রশ্ন উঠেছে—এই ফোনালাপ কী পরিকল্পিতভাবে ফাঁস করা হয়েছিল, না কি এটি কোনো ‘ইনসাইডার ষড়যন্ত্র’-এর অংশ?
সীমান্ত বাণিজ্যে অপরাধ সিন্ডিকেটের আধিপত্য
থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্ত বরাবর হাজার কোটি টাকার অবৈধ চোরাচালান ব্যবসা চলে আসে বহু বছর ধরে। সম্প্রতি থাইল্যান্ড সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কড়াকড়ি করে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিছু প্রভাবশালী চোরাকারবারি চক্র, যারা সেনা ও সীমান্ত পুলিশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
কম্বোডিয়া তার প্রতিক্রিয়ায় থাই পণ্য নিষিদ্ধ করে এবং সীমান্ত আমদানি-রপ্তানিতে বন্ধ ঘোষণা দেয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে—এই সিদ্ধান্তের পেছনেও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক লবির হাত ছিল, যারা চায় নিজ দেশের কৃষিপণ্য ও জ্বালানি বাজারে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে।
প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দির: ধর্মীয় স্থান না খনিজ লোভের কেন্দ্র?
এই প্রাচীন হিন্দু মন্দির নিয়ে আইসিজের (আন্তর্জাতিক বিচার আদালত) রায় দুইবারই কম্বোডিয়ার পক্ষে গেলেও থাইল্যান্ড সেই রায় মানতে নারাজ। অনুসন্ধানে উঠে আসে—এই মন্দির এলাকা ঘিরে রয়েছে মূল্যবান খনিজ ও পাথর সম্পদ, যার ওপর চীনা ও রুশ কোম্পানিগুলোর নজর বহু বছর ধরেই।
কম্বোডিয়া এবার আবারও আইসিজে-তে যাচ্ছে, কিন্তু থাইল্যান্ড তা প্রত্যাখ্যান করছে—এই বিরোধের পেছনে অর্থনৈতিক অপরাধ এবং আন্তর্জাতিক করপোরেট স্বার্থের গোপন তৎপরতা স্পষ্ট।
কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনমন: স্রেফ দ্বন্দ্ব, নাকি ষড়যন্ত্রমূলক বিচ্ছিন্নতা?
সংঘর্ষের পর থাইল্যান্ড কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ‘ডাউনগ্রেড’ করে। অনেকেই মনে করছেন, এটি ছিল উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা ঢাকতে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করার একটি রাজনৈতিক অপরাধমূলক কৌশল।
আসিয়ানরা চুপ কেন? লবির প্রভাবে নিষ্ক্রিয়তা?
আঞ্চলিক সংস্থা আসিয়ান থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া বিরোধে কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেয়নি। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আসিয়ানের স্থবিরতা অনেকাংশে চীনা লবির প্রভাব ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পরস্পরবিরোধী স্বার্থের কারণে।
সীমান্তে বারুদের গন্ধ নয়, লুকিয়ে আছে অপরাধ, ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতির ধোঁয়া
প্রসঙ্গত, থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘর্ষ নিছক প্রতিরক্ষা বা সীমানা বিরোধ নয়। এটি এক জটিল অপরাধচক্রের গল্প, যেখানে সামরিক কর্তৃত্ব, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ, রাজনৈতিক বিভাজন এবং চোরাচালান সিন্ডিকেট একসাথে জড়িত।
এই আগুন নিভবে কূটনীতিতে নয়—নিবৃত্ত হতে হবে সত্য উদ্ঘাটনের মাধ্যমে, অপরাধীদের বিচারের মুখে এনে। নচেত, সীমান্তের প্রতিটি বিস্ফোরণ শুধু মৃত্যু নয়—প্রমাণ হয়ে থাকবে রাষ্ট্রীয় অপরাধের নীরব সাক্ষী।
বিআলো/নিউজ