দক্ষিণ এশীয় প্রথম দেশ হিসেবে জাতিসংঘের পানি কনভেনশনে যোগ দিলো বাংলাদেশ
ইস্রাফিল হাওলাদার: বাংলাদেশ একটি নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। জাতিসংঘের আন্তঃসীমান্ত জলাধার ও আন্তর্জাতিক হ্রদ সংরক্ষণ ও ব্যবহার বিষয়ক কনভেনশনে (UN Water Convention) আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়ে দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের ৫৬তম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘের এই কনভেনশন আন্তঃসীমান্ত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় টেকসই সহযোগিতা ও ন্যায্যতার একটি বৈশ্বিক কাঠামো হিসেবে পরিচিত।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) জাতিসংঘ তথ্য কেন্দ্র ঢাকা থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জাতিসংঘ। বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ২৩ জুন ২০২৫ জাতিসংঘের আন্তঃসীমান্ত জলাধার ও আন্তর্জাতিক হ্রদ সংরক্ষণ ও ব্যবহার বিষয়ক কনভেনশন-এ (UN Water Convention) যোগ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের ৫৬তম দেশ হিসেবে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদী। এর মধ্যে গঙ্গা (পদ্মা), ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা—এই GBM নদী ব্যবস্থাই গঠন করেছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও জটিল বদ্বীপ, যা চীন, নেপাল, ভুটান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে এসে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। এই প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনাই বাংলাদেশকে পানি-নির্ভর ও সহযোগিতা-নির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বিপর্যস্ত পানি নিরাপত্তা। বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০–২৫% ভূমি পানিতে তলিয়ে যায়। চরম বন্যার সময় এ হার ৬০% পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। দেশের প্রায় ৬০% জনগণ উচ্চ বন্যা ঝুঁকির মুখে রয়েছে। প্রায় ৪৫% মানুষ উচ্চ নদীভিত্তিক বন্যার ঝুঁকিতে থাকে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। পাশাপাশি খরা, অনিয়মিত পানিপ্রবাহ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ও নিরাপদ স্যানিটেশন ঘাটতি বাংলাদেশকে গভীর সংকটে ফেলেছে।
বিশ্বের ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশের (LDCs) একটি, বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষের বাস, যাদের একটি বড় অংশ পানিসংক্রান্ত ঝুঁকির সম্মুখীন। প্রায় ৬০% মানুষ উচ্চ বন্যা ঝুঁকিতে রয়েছে, যা বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি (নেদারল্যান্ডস বাদে)। প্রায় ৪৫% জনগণ উচ্চ নদীভিত্তিক বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ অনুপাত। প্রতি বছর বাংলাদেশের ২০–২৫% ভূমি পানির নিচে ডুবে যায় এবং চরম বন্যার সময় তা ৫৫–৬০% পর্যন্ত পৌঁছায়। এখনও ৬৫ মিলিয়নের বেশি মানুষ নিরাপদ স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
জাতিসংঘ ও সরকারের নেতৃবৃন্দ বলছেন, জাতিসংঘ ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিশনের নির্বাহী সচিব তাতিয়ানা মলচিয়ান বলেন: “বাংলাদেশের এই যোগদান দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি পথপ্রদর্শক। জলবায়ু সংকট ও পানির ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ মোকাবেলায় আরও দেশ যেন এই কনভেনশনে যুক্ত হয়, সেই আহ্বান জানাচ্ছি।”
বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়াদা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও জাতিসংঘ পানি কনভেনশন থেকে আমরা শিখে টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার নীতি ও কৌশল গড়ে তুলতে পারবো, যা দেশের পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।”
বাংলাদেশ ২০১২ সাল থেকেই কনভেনশনের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আসছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে স্লোভেনিয়ায় আয়োজিত ১০ম সদস্য বৈঠকে অংশ নেয়। ২০২৫ সালের ২৪ মার্চ ঢাকায় UN Water Convention–বিষয়ক একটি জাতীয় কর্মশালার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।
আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আগামীর সম্ভাবনায় দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনায় বহু সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের আছে ভারতের সাথে যৌথ নদী কমিশনের মতো বিদ্যমান কাঠামো। UN Water Convention-এ অংশগ্রহণের ফলে এই ধরণের চুক্তিগুলো আরও কার্যকর হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতিসংঘ পানি কনভেনশন সচিব সোনিয়া কপেল বলেন, “বাংলাদেশকে অভিনন্দন। আমি আশা করি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোও এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হবে। জাতিসংঘ তাদের পাশে রয়েছে-২০২৬ সালের ডিসেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ পানি সম্মেলনকে সামনে রেখেই আমরা প্রস্তুত।”
জাতিসংঘের পানি কনভেনশন গৃহীত হয় ১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ। ২০১৬ সাল থেকে এটি জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রের জন্য উন্মুক্ত। বর্তমানে ৫৬টি দেশ সদস্য, যার মধ্যে রয়েছে আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ। আরও ২০টির বেশি দেশ সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
বিআলো/তুরাগ