নর্থ সাউথ ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা, দুদককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ
বিশেষ প্রতিনিধি: মাছের পচন শুরু মাথা থেকে। আর জাতির পচন ধরে শিক্ষা ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা থেকে। দেশের দুর্নীতিবাজদের তালিকা দীর্ঘ করলে সেখানে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশি। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। এডিস মশা যেমন লাভা ছড়ায়ে ডেঙ্গু রোগকে বাড়াচ্ছে তেমনি এইসব শিক্ষিত মানুষের কারণে দেশে আজ দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। বেসরকারি খাতের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। অনিয়ম- দুর্নীতির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলাটির অভিযোগপত্রও দাখিল হয়েছে আদালতে।
তবে অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মদতপুষ্ট একটি গোষ্ঠীর প্রভাবে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ অন্য সদস্যদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে উৎখাত করতে দুদককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সূত্র জানায়, তাদের সরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করারও চেষ্টা করেছিল তৎকালীন সরকারের সুবিধাভোগী সেই গোষ্ঠী।
সূত্র বলছে, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টিদের উচ্ছেদের মাধ্যমে সেখানে দখল ও লুটপাট চালানোর প্রাথমিক অভিযোগ হলো সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী দীপু মনি ও প্রতিমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে। সে সময় ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন শিল্পপতি ও পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত এম এ হাসেম। তিনি অষ্টম জাতীয় সংসদে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন। বিএনপি সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ও এম এ হাসেমের বিএনপির সংসদ সদস্য থাকার বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়েই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিএনপি সমর্থিত প্রতিষ্ঠান অজুহাতে আওয়ামী সরকার ও সরকার দলীয় কিছু সুবিধাভোগীরা দখল ও লুটপাটের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় বলে দাবি একাধিক সূত্রের। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় দখলের জন্য বিগত সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের নির্দেশ অনুযায়ী ভুয়া মানবাধিকার সংগঠন ‘আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সুফী সাগর সামসকে দিয়ে একের পর এক সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করানো হয়। দুদকেও তাকে দিয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হয়। ফলে এক ধরনের চাপ থেকে সংস্থাটি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে।
এদিকে জানা গেছে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাটিদের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করা ও সংবাদ সম্মেলন করে বেড়ানো সূফী সাগর সামসের। যার বিদ্যার দৌড় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। অথচ নিজেকে পরিচয় দিতেন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী হিসেবে। মানবাধিকার সংগঠনের উপদেষ্টা পরিচয়ের আড়ালে বিগত সরকারের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী ও সরকারদলীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদতে সূফী সাগর তার মূল পেশা চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে প্রতারণায় নামে। একাজে তিনি টার্গেট করেন বিভিন্ন পর্যায়ের ধনাঢ্য ব্যক্তি, শিল্পপতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন ব্যক্তিদের টার্গেট করে তাদের বিরুদ্ধে বানোয়াট ও ভুয়া তথ্য দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ তৈরি করতেন। পরবর্তীতে সেসব অভিযোগ চিঠি আকারে বিভিন্ন দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে পাঠাতেন। তিনিসহ চক্রের অন্য সদস্যরা ওইসব চিঠির কপি দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিকট মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করতেন। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ভুয়া মানবাধিকার সংগঠনের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে অসত্য তথ্য দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় করে হয়রানির ভয় দেখাতেন। চলতি বছর ১ এপ্রিল এসব অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তারও করে ডিবি পুলিশ।
সূত্র বলছে, ভুয়া ডক্টরেট দাবি করা সূফী সাগর সামসের আবেদন করা অভিযোগই আমলে নিয়ে এবং সরকারের মদতপুষ্ট সেই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাবে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান, মামলা এবং চার্জশিট দিয়েছে দুদক। অভিযোগ রয়েছে, যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মদতপুষ্ট সেই কিছু কুচক্রী, ক্ষমতালিন্দু, দখলদারদের হস্তক্ষেপে সঠিক অনুসন্ধান এবং বিবেচনা ও তদন্ত না করেই তড়িঘড়ি করে জমি ক্রয় সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগ এনে দুদক এই মামলা দায়ের ও চার্জশিট দাখিল করে।
সূত্র আরো জানায়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় জমি ক্রয় সংক্রান্ত সকল সরকারি আইনকানুন তথা ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা মেনে তৎকালীন সময়ের বাজারমূল্য অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন ফি ও অন্যান্য কর পরিশোধ করে আশালয় হাউসিং লিমিটেডের কাছ থেকে সমপ্রসারিত ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য পূর্বাচলে ২৫০ বিঘা জমি ক্রয় করে। যে জমি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আশালয় হাউসিং-এর সঙ্গে মোসাদ্দেক আলী ফালুর (বিশেষ সহকারী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া) মালিকানা সংশ্লিষ্টতা থাকা এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিন মোহাম্মাদ হিলালীর বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাকেও সেই সুবিধাবাদীরা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে তাদের হেয় করতে ব্যবহার করেছে। এছাড়াও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ডের ব্যবহারের জন্য উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহণ পুলের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি ক্রয়ের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডের টাকা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও আত্মসাতের অভিযোগ তুলে দুদক আরেকটি মামলা দায়ের করে বলে জানা যায়।
নর্থ সাউথ সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ এর বিধান মেনে ট্রাস্টিবোর্ড সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে গাড়ি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয় এবং গাড়ি ক্রয়ের জন্য সরকারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ও ক্রয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী গাড়িগুলো ক্রয় করা হলেও শুধু ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যদের অপসারণের অপকৌশল করে তৎকালীন সরকারের নীল নকশা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে দুদককে ব্যবহার করে এই মামলা করা হয়। দুদককে ব্যবহার করে এই মামলায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিবোর্ডের অসুস্থ ও বয়স্ক সদস্যবৃন্দ এম এ কাশেম, মোহাম্মদ শাহজাহান, রেহানা রহমান এবং বেনজির আহমেদকে শারীরিক ও মানসিক হয়রানি নর অভিযোগও উঠেছে।
জানা যায়, ওই চারজন ট্রাস্টি এই মামলায় আগাম জামিনের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হন। যে মামলার চার্জশিট না থাকা সত্ত্বেও সরকারের মদতপুষ্ট সেই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথপ্রদর্শক, দেশ ও জাতি গঠনে সর্বদা নিয়োজিত এবং নিয়মিত উচ্চ কর প্রদানকারী এই ট্রাস্টিদের (একজন মহিলাসহ) নজিরবিহীনভাবে জেল হাজতে পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে ট্রাস্টি বোর্ডের অন্য সদস্যদের জেল-জুলুমের ভয় দেখিয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে ওই চারজনসহ ছয়জন প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ আওয়ামী ঘরানার ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে দেয়া হয়। একই সঙ্গে এই মামলার অপর এক অভিযুক্ত আবাসন ব্যবসায়ী আমিন মোহাম্মদ হিলালীকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে জোর করে অভিযোগের বিষয়ে স্বীকারোক্তি আদায় এবং তা ভিডিও ধারণ করা হয়। এরপর তাকে দায়ের করা দুদক কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন পাটোয়ারী সম্প্রতি অবসরে গেছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, মামলার বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দুদকের আইন অনুবিভাগে তথ্য চেয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাকে কিছু জানানো হয়নি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সাউথইস্ট ব্যাংকও দখল করে নেয় আওয়ামী লীগ সরকারের মদতপুষ্ট একটি গোষ্ঠী। এমনটাই অভিযোগ করেন নর্থ সাউথ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা।
তারা জানান, বেসরকারি খাতের অন্যতম সফল ব্যাংক সাউথইস্ট ব্যাংকটি দখল করতে বেছে নেয়া হয় ২০০২ সালে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত হওয়া আলমগীর কবিরকে। ২০০৪ সাল থেকে টানা ২০ বছর সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন আলমগীর কবির। ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী এই পদে থেকে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পর্ষদে যুক্ত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, আলমগীর কবিরের যাবতীয় অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে যাতে কোনো প্রশ্ন না ওঠে এজন্য ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং প্রাক্তন এফবিসিসিআই সভাপতি ও শিল্পোদ্যোক্তা এম এ কাশেম, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আজিম উদ্দিন আহমেদ ও পরিচালক রেহানা রহমানকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি হিসেবে জমি সংক্রান্ত দুদকের দাবিকৃত কিন্তু অপ্রমাণিত অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যাংকটির পরিচালনা পরিষদ থেকে বাদ দেয়া হয়। আলমগীর কবির তার ইন্ধন ও নির্দেশনায় দ্বিতীয় প্রজন্মের এই ব্যাংকটিকে লুটপাট ও অর্থ পাচারের আখড়ায় পরিণত করেন। আর এমন কাজে বিগত সরকারের প্রকাশ্য ইন্ধন ও সহায়তা পান আলমগীর কবির। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত পুঁজিবাজার থেকে এক দিনেই সাউথইস্ট ব্যাংকের ২ কোটি ৩৭ লাখ ৭৮ হাজার ৮১০টি শেয়ার কিনে নেন যা পরিচালক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ২ শতাংশের বেশি। এর মাধ্যমে নাফিজ সরাফাতের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদকে পরিচালক হিসেবে যুক্ত করা হয়। দায়িত্বে থাকাকালীন আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অনিয়ম তদন্তে হাইকোর্ট অনুসন্ধানের জন্য দুদককে নির্দেশ দিলেও ক্ষমতার প্রভাবে তা ধামাচাপা পড়ে।
বিআলো/তুরাগ