নিউইয়র্কে এনসিপি নেতা আখতারের ওপর ডিম নিক্ষেপ
আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা : প্রেস সচিব
আখতারের ওপর হামলা কূটনৈতিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার চরম ব্যর্থতা: এনসিপি
নিউজ ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ডিম নিক্ষেপ ও হেনস্তার ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় সময় গত সোমবার নিউইয়র্কের কেনেডি বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় এই ঘটনা ঘটে। আখতার হোসেনকে হেনস্তার একটি ভিডিও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, বিমানবন্দর থেকে লাগেজ হাতে রাস্তা পার হচ্ছিলেন আখতার হোসেন। তার পাশেই ছিলেন এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা এবং তার একটু সামনেই ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির।
এ সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আক্তার হোসেনকে উদ্দেশ্য করে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ আখ্যা দিয়ে তার ওপর ডিম নিক্ষেপ করেন। এরপর আরেক ভিডিওতে আখতার হোসেনকে নিউইয়র্কে এনসিপির নেতাকর্মীদের সঙ্গ নিয়ে ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দেখা যায়। আখতার হোসেন বলেন, আমরা সেই প্রজন্ম যারা হাসিনার গুলির সামনে মাথা নত করিনি, ভাঙা ডিমে কিছু যায় আসে না। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হয়েছে আওয়ামী লীগ একটা সন্ত্রাসী সংগঠন। এদিকে আখতার হোসেনকে হেনস্তার প্রতিবাদে তাসনিম জারা ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, আজ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর পর আমাদের দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর হামলা হয়েছে। তাকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়া হয়েছে, গালিগালাজ করা হয়েছে। এটি ব্যক্তি আখতার হোসেনের ওপর আক্রমণ নয়, তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে করা হয়েছে। কারণ তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন সেই দলকে, যে দল ফ্যাসিবাদের কাঠামো ভেঙে দিতে প্রতিনিয়ত কাজ করছে।
তিনি আরও লিখেছেন, এই হামলা স্পষ্ট করে দেয়, পরাজিত শক্তির ভয় ও হতাশা কতটা গভীর। আমি নিশ্চিত, এই আক্রমণ আখতার হোসেনকে এক বিন্দুও দুর্বল করবে না; বরং তার অঙ্গীকারকে আরও দৃঢ় করবে। এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে লিখেছন, হাসিনার পুলিশ লীগ, কোট-কাচারিও আখতারকে দমন করতে পারেনি। আর এসব উচ্ছিষ্ট, জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত দালালরা বিদেশে বসে প্রতিবাদের প্রতীক আখতারকে দমন করতে পারবে? হাসনাত আরও লিখেছেন, আওয়ামী দালালদের পক্ষে টকশো আর যুগলবন্দী কলামে যারা ‘সম্মতি’ উৎপাদন করে, তাদেরও কেন প্রত্যাখ্যান করা উচিত – এটা না বুঝলে, কিছুদিন পর এই আক্রমণের শিকার হতে আপনি প্রস্তুত থাকুন। এনসিপির উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন, এই পা চাটা দালাল এবং জনতার ভয়ে জান নিয়ে পালিয়ে যাওয়া তাদের মা হাসিনা- হাজারের অধিক খুনের নির্দেশদাতা। বিগত ১৭ বছরে এই দেশে গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, ধর্ষণ থেকে শুরু করে এমন কোনো ঘৃণিত কাজ ও অন্যায় নেই, যা তারা করেনি।
তিনি আরও বলেন, ওদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। দালালি করতে করতে আর পা চাটতে চাটতে এরা এদের বিবেকবোধ হারিয়ে ফেলেছে। এরা এদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য অভিশাপ। সারজিস বলেন, এই নরপশুদের আর ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। যারা অর্থসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার বিনিময় এই শয়তানদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন তারা সাবধান হয়ে যান। সুযোগ পেলে এই কালো সাপগুলো আপনাদেরকেই ছোবল মারবে। এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন লিখেছেন, ড. ইউনূস নিজের স্বার্থে পার্টিগুলোকে ব্যবহার মারফত ম্যান্ডেট কামাই করে যাচ্ছে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি ও পরর্বতীতে এনসিপির রাজনৈতিক শক্তিকে নিজের পক্ষে শো অফ করে শক্তিশালী হয়েছেন ষোল আনা। কিন্তু নিজের সফরসঙ্গীদের, তার চেয়ে বড় কথা জুলাই অভ্যুত্থানের নেতা আখতার হোসেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ন্যূনতম আদব না দেখিয়ে তিনি তার দুরভিসন্ধি প্রকাশ করে দিয়েছেন।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাজনুভা জাবিন লিখেছেন, নিউইয়র্কে জারাকে যে অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করা হলো আখতারের ওপর হামলা করা হলো, তাও বাংলাদেশ সরকারের সফর সঙ্গী হিসেবে এর চেয়ে নিন্দনীয় কিছু হতে পারে না। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে এর জবাব দিতে হবে। কেন এরা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিরাপত্তা দিতে পারে নাই।
কেন তারা একমাত্র নারী রাজনৈতিক প্রতিনিধিকে নিরাপত্তা দিতে পারে নাই। অন্তর্বর্তী সরকারকে এদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। জারার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। মুখে নারী নারী করে ফেনা তুলে ফেলে, অথচ সাথে করে নিয়ে তাকে আক্রমণের মুখে ফেলে রেখে চলে গেছে। তিনি আরও বলেন, আখতার শুধু এনসিপির নেতা না, আখতার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জীবন্ত প্রতীক। ইতিহাস সাক্ষী, আখতার রাজপথে থেকে, জেল জুলুম সহ্য করে হাসিনাকে বিতারিত করেছে দেখেই আজকে আপনারা একেকজন উপদেষ্টা। যার অবদানে সরকার হইছেন তাকেই নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। ধিক্কার জানাই। এনসিপি এর জবাব নিয়ে ছাড়বে। এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আখতার হোসেনের ওপর হামলা আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্বের প্রমাণ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসররা দেশ থেকে পালিয়ে বাধ্য হয়। বিদেশে পালিয়েও তাদের যড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। তিনি হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে অনুরোধ জানান।
আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপ একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। গত সোমবার স্থানীয় সময় রাতে ম্যানহাটনের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। এনসিপি নেতার ওপর হামলার প্রসঙ্গে শফিকুল আলম বলেন, এটা একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এ বিষয়টি আমাদের কনস্যুলেট এবং ফরেন মিনিস্ট্রি দেখবে। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার আজ (গত সোমবার) জাতিসংঘে সোশ্যাল বিজনেসের সাইড ইভেন্ট ছিল, সেখানে তিনি বক্তব্য রাখেন। এরপর আরেকটি ইভেন্টে অংশ নেন। প্রধান উপদেষ্টাকে এসডিজি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। অ্যাওয়ার্ডটি তিনি ছাড়াও আরও দুই জন পেয়েছেন। প্রেস সচিব আরও বলেন, ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক বিশেষ দূত সার্জিও গোরের সঙ্গে বৈঠকে অনেক বিষয়ে আলাপ হয়েছে।
বাংলাদেশে সামনে নির্বাচন, সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন-নির্বাচনের জন্য দেশ মোটামুটি প্রস্তুত। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন হবে তিনি বলেছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা সব ধরনের সহযোগিতা বাংলাদেশকে দেবে। এ ছাড়া সার্ক পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে কথা হয়েছে। নেপাল-ভুটানের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে কথা হয়েছে। আসিয়ানে আমরা মেম্বারশিপ চাচ্ছি, সেটা নিয়ে কথা হয়েছে। শফিকুল আলম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়েও কথা হয়েছে। সার্জিও গোর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খুব কাছের মানুষ। এসব বিষয় নিয়ে তিনি সরাসরি ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলবেন।
যুক্তরাষ্ট্রে আখতারের ওপর হামলা কূটনৈতিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার চরম ব্যর্থতা: যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এসময় এনসিপির সিনিয় যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা তার পাশে ছিলেন। আখতার হোসেন ও তাসনিম জারার ওপর এই হামলার ঘটনাকে রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে দলটির প্রবাসী উইং ডায়াস্পোরা অ্যালায়েন্স। আজ মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এ ঘটনাকে রাজনৈতিক সহিংসতার বহিঃপ্রকাশ উল্লেখ করে তীব্র নিন্দা প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট সফরে অংশগ্রহণকারী জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা আখতার হোসেন ও তাসনিম জারার ওপর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমর্থক সন্ত্রাসীরা ন্যাক্কারজনক হামলা চালিয়েছে।
দলটির পক্ষ থেকে প্রশ্ন রেখে বলা হয়, যদি সরকারি সফরের অংশগ্রহণকারীরা ন্যূনতম নিরাপত্তা না পান, তবে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি কনস্যুলেট ও দূতাবাসগুলোর অস্তিত্বের যৌক্তিকতা কোথায়? তারা কাদের স্বার্থে কাজ করছে, আর কেন এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না? বাংলাদেশ সরকার এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রীয় সফররত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ উল্লেখ করে এই বিষয়ে অবিলম্বে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে তিন দফা দাবি উত্থাপন করা হয় বিবৃতিতে। দাবিগুলো হলো- বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার এবং নিউইয়র্ক শহরের সরকার ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সরাসরি অভিযোগ করতে হবে। নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল সহ সম্পূর্ণ ফরেন সার্ভিস টিমকে অবিলম্বে চাকরিচ্যুত করতে হবে।
সফরের পরবর্তী অংশের জন্য প্রত্যেক সফররত নেতাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, হামলার সময় এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও তাসনিম জারার সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্যান্য সফরসঙ্গীরাও ছিলেন এবং তারাও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তোপের মুখে পড়েন। কিন্ত এই হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে মূলত এনসিপির দুই নেতাকে। জুলাই বিপ্লবের সময় যারা জীবনবাজি রেখে লড়েছিলেন, তাদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হামলাকারীদের ক্ষোভ আজও থামেনি। এতে বলা হয়, আখতার হোসেনকে জুলাই আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার করে নির্যাতন চালানো হয়। তিনি গণআন্দোলনের জন্য নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছিলেন। অথচ আজও সেই সংগ্রামের মূল্য দিতে হচ্ছে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের চরম ব্যর্থতা। বিদেশের মাটিতে এ ধরনের হামলা বাংলাদেশের মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
বিআলো/ইমরান