পানি নেই, ভরা মৌসুমে নেই প্রবাহ কিশোরগঞ্জবাসীর অভিশাপ হয়ে উঠেছে নরসুন্দা
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি: শুকনো মৌসুমে এখন নরসুন্দায় পানি নেই, ভরা মৌসুমে নেই প্রবাহ। নোংরা-ময়লা-আবর্জনায় ভাগাড়ে পরিণত হয়ে এখন কিশোরগঞ্জবাসীর অভিশাপ হয়ে উঠেছে। সীমাহীন অযত্ন-অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় কিশোরগঞ্জ শহরের প্রাণ নরসুন্দা নদী এখন দখল-দূষণ ও ভরাটের মহোৎসবে বিপন্ন। এক শ্রেণির ভূমিদস্যুদের দখল-ভরাটে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে নদীটি। এদিকে কিশোরগঞ্জের প্রাণ নরসুন্দা নদীকে বাঁচাতে কাওনার বাঁধ খুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। তারা বলছেন, নরসুন্দা রক্ষায় উৎসমুখে কাওনার বাঁধ খুলে দিয়ে এবং ব্রহ্মপুত্র থেকে একটি খাল এনে নরসুন্দার উৎসমুখে সংযোগ করে দিলে নরসুন্দার প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।
দ্রুত পূর্ণ খনন কাজের পাশাপাশি অবৈধ দখলমুক্ত করে নদীটিকে বাঁচিয়ে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবাদী সংগঠন ও পরিবেশবাদীরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জুয়েল জানান, আশির দশকের শুরুতে কাওনায় অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করে নরসুন্দা নদীর প্রাণ প্রবাহ বন্ধ করে প্রথমবারের মতো নরসুন্দা নদীকে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, নরসুন্দা রক্ষায় উৎসমুখে কাওনার বাঁধ খুলে দিতে হবে এবং ব্রহ্মপুত্র থেকে একটি খাল এনে নরসুন্দার উৎসমুখে সংযোগ করে দিতে হবে। তবেই নরসুন্দার প্রাণ রক্ষা পাবে। তিনি বলেন, সিএস মূলে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে সঠিক পিলার স্থাপন করতে হবে। আংশিক নয় সম্পূর্ণ নরসুন্দা খনন করতে হবে। ইতোপূর্বে নরসুন্দার খনন কাজে সংঘটিত ব্যাপক দুর্নীতির তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এখনো যারা ময়লা-আবর্জনা ফেলে নরসুন্দাকে দূষণ করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই প্রাণ ফিরবে নরসুন্দার। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর ও ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে প্রবাহিত দেশের অন্যতম বৃহত্তম নদ ব্রহ্মপুত্র থেকে নরসুন্দা নদীর উৎপত্তি। নদীটি হোসেনপুর থেকে কিশোরগঞ্জ শহরের মাঝপথ দিয়ে করিমগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে ৯৭ কিলোমিটার বহমান থেকে করিমগঞ্জের কাছে ধনু নদীতে গিয়ে পড়েছে। এ নদীটির তীরেই একসময় গড়ে ওঠে প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ জনপদ কিশোরগঞ্জের নগরসভ্যতা।
আশির দশক পর্যন্তই নদীপথে ছোট-বড় নৌযান চলাচল করে বাণিজ্য পরিবহন ও যোগাযোগ এমনকি পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে কিশোরগঞ্জবাসীর জন্য অসামান্য অবদান রেখে আসছিল এই নরসুন্দা নদী। কিন্তু নব্বই দশকের শুরু থেকে ভূমিদস্যুদের লোলুপ দৃষ্টির শিকার হয়ে দখল-দূষণ-ভরাটে বিপন্ন হয়ে পড়েছে এই গুরুত্বপূর্ণ নরসুন্দা নদীটি। পরিবেশবাদীদের দাবি ও আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১২ সালে ১০৬ কোটি টাকার নরসুন্দা নদী খনন ও সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প হাতে নেয়। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ২০১৬ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। নাম দেওয়া হয় নরসুন্দা লেকসিটি। নদী দখলবাজদের চিহ্নিত করে অভিযানও শুরু হয়। তবে সে উদ্যোগও তখনকার সরকারের লোকজনের জন্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই সে অভিযান থমকে দাঁড়ায়। সেই প্রকল্পের মাধ্যমেও নরসুন্দাকে হত্যা করা হয়েছে লেক সিটি নামে। নদী কীভাবে লেকসিটি হয় এমনটিই প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। এখন আষাঢ় মাসের ভরা বর্ষায়ও মরা খালে পরিণত হয় কিশোরগঞ্জবাসীর প্রাণ নরসুন্দা নদী। কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, নরসুন্দা নিয়ে পরিকল্পনা ও সমীক্ষার কাজ চলমান রয়েছে। এই সমীক্ষার ভিত্তিতে খুব শিগগিরই প্রকল্প প্রস্তাবনা দাখিল করা হবে। আর ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নরসুন্দা নদীতে পানি প্রবাহ ফিরে আসবে।