পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্র নিয়ে চরম বিতর্ক
স্বার্থবিরোধ, প্রভাব ও অনিয়মের অভিযোগে তোলপাড়
নিজস্ব প্রতিবেদক: পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা পরিবহন ও লাইটারিং পরিষেবার সাম্প্রতিক দরপত্রকে ঘিরে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্পের অন্যতম মালিকানা প্রতিষ্ঠানই নিজস্বভাবে দরপত্রে অংশ নিয়ে স্বার্থবিরোধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। যা বাংলাদেশের সরকারি ক্রয়নীতির (Public Procurement Rules – PPR 2008) সরাসরি পরিপন্থী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র জানায়, “এসএইইটি-সিনোট্রান্স জেভি” নামের যৌথ কোম্পানিটি দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে তালিকায় উঠে এসেছে। এই কোম্পানির বাংলাদেশের অংশীদার ‘সাউথ এশিয়া এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি লিমিটেড’ (এসএইইটি), যা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল মালিক কোম্পানি চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি)-এর স্থানীয় প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠান। ফলে একই প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন কোম্পানি আবার সেই প্রকল্পের টেন্ডারে অংশ নেওয়ায় স্বার্থবিরোধের অভিযোগ উঠেছে।
বিসিপিসিএল (Bangladesh-China Power Company Ltd.) হচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক ও পরিচালনাকারী যৌথ প্রতিষ্ঠান, যার সমান অংশীদার বাংলাদেশ ও চীন। বাংলাদেশের অংশীদার প্রতিষ্ঠান হলো নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড, আর চীনের অংশীদার সিএমসি। কিন্তু বিতর্কিত এসএইইটি কোম্পানিটি সিএমসি’রই বাংলাদেশি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। ফলে একই গোষ্ঠী একদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক, অন্যদিকে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী—যা প্রকিউরমেন্ট নীতির দৃষ্টিতে সরাসরি স্বার্থবিরোধের শামিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিসিপিসিএল’র বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াংজি একই সঙ্গে এসএইইটি কোম্পানিরও নির্বাহী হিসেবে যুক্ত আছেন। এই দ্বৈত ভূমিকার কারণে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের পূর্ববর্তী প্রশাসনকালে প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি এই কোম্পানিকে একাধিকবার টেন্ডারবিহীনভাবে সরাসরি চুক্তি প্রদানের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও বিসিপিসিএল প্রশাসনের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সহযোগিতায় এসএইইটি ১০ বছরের জন্য পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা ও যন্ত্রাংশ সরবরাহের সুযোগ পেয়েছিল বিনা টেন্ডারে। এতে জড়িত ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস এবং বিসিপিসিএল’র সাবেক এমডি খুরশেদ আলম। আগের টেন্ডারেও এসএইইটি কোম্পানি “নিজস্ব জাহাজ” থাকার দাবি করলেও বাস্তবে তারা চীন থেকে সেই জাহাজ আনেনি। পরিবর্তে নিম্নমানের স্থানীয় জাহাজ ব্যবহার করে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালানো হয়, যার ফলে সিস্টেম লস ও দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। এবারও একই পদ্ধতিতে কাজ করার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
চলতি টেন্ডারে কয়লা সরবরাহের জন্য মোট ছয় থেকে সাতটি কোম্পানি অংশ নেয়। এর মধ্যে তিনটি কোম্পানিকে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করা হয়। এগুলো হলো—এসএইইটি–সিনোট্রান্স জেভি, বসুন্ধরা মাল্টি ট্রেডিং লিমিটেড (বিএমটিএল) এবং দেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন ও বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (জেভি)। তাদের প্রস্তাবিত বিড মূল্য যথাক্রমে ৫৩৭ কোটি ৪৬ লাখ, ৫৭৫ কোটি ৭৬ লাখ এবং ৫৮৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। বিএমটিএল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তাদের বিড মূল্যে ২০ শতাংশ ভ্যাট ও কর যুক্ত করা হয়েছে। যদি বিসিপিসিএল এই কর বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করে, তাহলে বিএমটিএলই বাস্তবে সর্বনিম্ন দরদাতা হবে।
এই বিষয়ে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল হক বলেন, “এই বিষয়টি আমাদের বোর্ড দেখছে। মূলত কম রেট আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। টেন্ডার ডকুমেন্টে যা বলা আছে, সেটি অনুসারেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
এদিকে বিদ্যুৎখাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো রাষ্ট্রীয় অংশীদারিত্ব প্রকল্পে বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে আরও কঠোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাদের মতে, একই গোষ্ঠীর মালিকানা থাকা প্রতিষ্ঠান যদি টেন্ডারে অংশ নেয়, তাহলে এটি প্রতিযোগিতামূলক প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত করে।
বিশ্লেষকরা আরও বলেন, বিসিপিসিএল ও সিএমসি’র পূর্ববর্তী ও বর্তমান টেন্ডারগুলো পুনর্বিবেচনা এবং স্বাধীন অডিট করা জরুরি। প্রয়োজনে সিপিটিইউ ও বিপিপিএ’র মাধ্যমে তদন্ত করে দেখা উচিত, কোনো প্রভাব বা স্বার্থবিরোধ আছে কিনা। এ ছাড়া প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন ও সংশ্লিষ্ট নথিপত্র প্রকাশ।
পর্যবেক্ষকরা সতর্ক করে বলেন, বিদ্যুৎখাতে এ ধরনের অনিয়ম চলতে থাকলে সরকারি ক্রয়ব্যবস্থার প্রতি জনআস্থা নষ্ট হবে এবং উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে, যার চাপ সরাসরি ভোক্তার ওপর পড়বে। তারা দ্রুত স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে রাষ্ট্রীয় অর্থব্যয়, বিদ্যুৎখাতের সুশাসন এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা রক্ষা করা যায়।
বিআলো/তুরাগ