শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.): আলোচিত জীবন, বিকৃত পাঠ ও আত্মিক সংগ্রাম
ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে এমন কিছু নাম, যাদের পরিচয় কখনো আলোকরেখা, কখনো বিতর্ক, আবার কখনো প্রজন্মের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া সত্য। শাহ ইসমাঈল দেহলভী (রহ.)-তার জীবন এবং সংগ্রাম তেমনই এক অনালোকিত অধ্যায়, যা আজ নতুন আলোয় পাঠের দাবি রাখে। শাহ ইসলাম দেহলভী (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন ১১৯৩ হিজরির ২২ রবিউল আউয়াল (২৬ এপ্রিল ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে) মুসলমান পারিবারিক পরিবেশে। তার পিতা শাহ আব্দুল গনি (রহ.) ছিলেন প্রভাবশালী মুহাদ্দিস ও হাফেজ, যার নিকট থেকেই ছোট থেকেই তিনি কুরআন-হিফজ শুরু করেন এবং মাত্র আট বছর বয়সে ‘হাফেজ’ উপাধি অর্জন করেন ।
১২০৩ হিজরিতে (১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে) পিতার প্রারম্ভিক মৃত্যুতে তিনি তার চাচা-শাহ আব্দুল আজিজ (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে পৌঁছান এবং দিল্লির মাদরাসা-ই-রহিমিয়্যাহ-তে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পান । এখানে তিনি অর্জন করেন: দারুল-হাদীস ও ফিকহ, তাওহিদ, কালাম এবং যুক্তি (মানতিক), দর্শন পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাদানের দায়িত্বও গ্রহণ করেন।
ঐতিহাসিকভাবে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)-এর চিন্তা-ধারা তার শিক্ষাজীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তার যুগে এমন একটি প্রাচীন কেন্দ্রীয় মসজিদে (সম্ভবত মসজিদ-ই-আকবরাবাদী) তিনি নিয়মিত দারস বা দরস প্রদান করতেন। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, আকবরাবাদী মসজিদে তার পরিবারের অনেকেই-বিশেষ করে ভাই শাহ আব্দুল কাদের দেহলভী-সদা উপস্থিত থাকতেন এবং শিক্ষাদান করতেন । যদিও শাহ ইসমাঈল দেহলভীর সম্বন্ধে সরাসরি সেই মসজিদে দরস দেওয়ার তথ্য প্রতিলিপি পাওয়া যায়নি, এই ঐতিহ্য হিসেবেই ধারাবাহিকতা ধরে এমন সম্ভাব্যতা রয়েছে। শাহ ইসমাঈল দেহলভী (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন ভারত উপমহাদেশের অন্যতম জ্ঞানতীর্থ দিল্লিতে, এক এমন পরিবারে-যা দীনি ইলম, তাজকিয়া এবং তাওহিদের চর্চায় পরিচিত ছিল সর্বত্র। তিনি ছিলেন মহান ইসলামি চিন্তাবিদ ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ.)-এর সরাসরি বংশধর।
পারিবারিকভাবে এ পরিবারের সবাই মাদরাসা-ই-রহিমিয়্যাহ ও আকবরাবাদী মসজিদ ঘিরে গড়ে ওঠা একটি তাওহিদ-ভিত্তিক সংস্কারবাদী চিন্তাধারার ধারক ছিলেন। শিশুকাল থেকেই শাহ ইসহাক (রহ.) এমন পরিবেশে বড় হন, যেখানে কুরআন-হাদীসের গভীর জ্ঞান, ইজতিহাদের স্বাধীনতা ও হৃদয়স্পর্শী আধ্যাত্মিকতার সমন্বয় ছিল। ঘরের বাতাসেই ভাসত হাদিসের পাঠ, ফিকহ ও তাফসিরের আলোচনা, বিদআত ও শিরকের বিরুদ্ধ সচেতনতা, আর দাওয়াতি চেতনার গভীর বুনন। তার পরিবার কেবল জ্ঞানসম্পন্নই ছিল না, বরং ইসলামী সমাজ সংস্কারের জন্য আত্মত্যাগে প্রস্তুত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক বংশ। তার শিক্ষা, চিন্তা ও সমাজ রূপান্তরের দৃষ্টিভঙ্গি মূলত তার পরিবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। এই পারিবারিক-ধর্মীয় প্রভাব তার জীবন ও মিশনের প্রতিটি স্তরে প্রতিফলিত হয়-বিশুদ্ধ আকীদার প্রতি অনুরাগ, জ্ঞানচর্চায় গভীরতা এবং তাওহিদের জ্যোতি সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াসে।তিনি রচনা করেন তাক্বওয়িয়াতুল ঈমান ও সিরাতুল মুস্তাকিম-যা ছিল এক নতুন চিন্তার আলোড়ন।
তিনি বলেন, “আল্লাহই সব গায়েবের উৎস, নবী যতটুকু জানেন তা আল্লাহর ইলহাম ছাড়া নয়।” কিন্তু এই কথাকে বিকৃত করে বলা হয়েছে, “নবী কিছুই জানেন না”-যা ছিল না তার মূল বক্তব্য। তিনি বলেন, “ওলি সম্মানযোগ্য, উপাস্য নয়।” অথচ বলা হয়, “ওলির কথা মানাও শিরক!” এভাবে তার গ্রন্থগুলোকে এমনভাবে অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেন তিনি আকীদাহ বিরোধী অবস্থান নেন। অথচ তার নিজের জীবন ছিল তরিকত, মারেফাত ও শুদ্ধ আকীদার সম্মিলন। একদিকে তিনি ছিলেন রূহানিয়াত, আত্মশুদ্ধি ও তাওহিদের পথিক; অন্যদিকে ছিলেন উপনিবেশবাদ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধের অগ্রনায়ক। অথচ তার নামের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে এমন কিছু তকমা-যা তাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে। আজ প্রয়োজন সেই বিকৃত পাঠকে প্রশ্ন করা, এবং ইতিহাসের সত্য উচ্চারণ করা। তিনি ছিলেন না কোনো গোষ্ঠীগত সালাফি বা ওহাবি মতবাদের অনুসারী। ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুসারে, ওহাবি আন্দোলন মূলত সৌদি অঞ্চলে রাজনৈতিক ও সামরিক প্রেক্ষাপটে বিকশিত হয়েছিল এবং ভারত উপমহাদেশে এই মতবাদ ব্রিটিশ শাসনের সুবিধাভোগী হিসেবে গড়ে উঠেছিল।
শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.)-এর বালাকোট যুদ্ধের সহযোদ্ধাগণ অধিকাংশই ছিলেন ওয়ালিউল্লাহ পরিবারের সুফি ধারার মানুষ। তার দাওয়াত ছিল রূহানিয়াত ও আত্মিক জাগরণের সম্মিলন, যেটা কোনো রাজনৈতিক বা দলীয় মতবাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তার শিক্ষা, সাধনা ও আত্মত্যাগ সকলই প্রমাণ করে যে তিনি ছিলেন এক তাওহিদি আহ্বানদাতা, যিনি রূহানী দর্শনের ছত্রছায়ায় গঠিত আত্মমর্যাদাশীল মুসলিম জাতির স্বপ্ন দেখতেন। তার বিরোধিতাকারীরা মূলত তার তাওহিদের ব্যাখ্যাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে প্রচারণা চালায়, যাতে তাকে বিভ্রান্তিকর উপায়ে ‘সালাফি’ বা ‘ওহাবি’ প্রমাণ করা হয়। তার কিতাবসমূহের বহু পরবর্তী সংস্করণে মূল ইবারত হুবহু রাখা হয়নি-বরং মতবাদের প্রচারণায় খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সুন্নি জামাতের মাওলানা রেদওয়ানুল হক ইসলামাবাদী তার লিখিত গ্রন্থ ‘নজদী পরিচয়’ (ওহাবী আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাস)-এ দাবি করেছেন, “ইসমাঈল দেহলভী- পাঠানদের বাহিনীতে থাকার অনুমতির শর্ত হিসেবে দুই মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন।”এ বক্তব্য “কথিত আছে” এই বাক্য দিয়ে শুরু হওয়ায় তা সরাসরি ঐতিহাসিক দলিল নয়, বরং অনুমাননির্ভর প্রচারণা।যুদ্ধাবস্থায় বিয়ে শরিয়ত ও ফিকহের দৃষ্টিভঙ্গিবৈধ, তবে তিনটি শর্তে:১. ইজাব-ও-কবুল (উচ্চারণকৃত সম্মতি), ২. মোহরানা, ৩. সাক্ষী। ইসলামের ইতিহাসে যুদ্ধকালেও অনেক সাহাবী বৈধভাবে বিবাহ করেছেন-তাফসিরে কুরতুবী ও ইবনে হজর আসকালানীর রচনায় এমন উদাহরণ আছে।
ইমাম নববী (রহ.) বলেন: “যুদ্ধকালে কোনো মুসলিম নারী বা সমর্থিত সম্প্রদায়ের নারীকে বৈধভাবে বিবাহ করলে তা জায়েয”-রেফ: শরহ মুসলিম। ইবনে কুদামা (আল-মুগনী) বলেন: “যুদ্ধাবস্থায় যে বিবাহ সুন্নাহ মোতাবেক সম্পন্ন হয়, তা ইবাদতই গণ্য”-আল-মুগনী, খণ্ড ৭। “কথিত আছে” কথাটির ফিকহি মূল্যায়ন দিতে গিয়ে ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেন: “যে কথা দলিলহীন ও ‘কথিত’ হিসেবে প্রচারিত, তা বিদআত বা মিথ্যার উৎস হয়ে যায়”-সিয়ারু আ’লামুন্নুবালা। ইবনে আবেদীন (রহ.) বলেন: “মুফতী বা লেখক যখন ‘কথিত আছে’ বলে কিছু উপস্থাপন করেন, তা কোনো ফিকহি সিদ্ধান্ত বা বিশ্বাসযোগ্য বিবৃতিতে গণ্য হয় না”-রাদ্দুল মুখতার। বালাকোটের ঐতিহাসিক দলিল-পত্রে এ বিয়ের কোন অস্থিত্ব নেই। যা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা প্রোপাগান্ডা।
ইসলাম অনুযায়ী একজন পুরুষ চারটি পর্যন্ত স্থায়ী বিবাহ করতে পারেন যদি তিনি নারীদের প্রতি ন্যায্যতা বজায় রাখতে সক্ষম হন (সূরা নিসা ৪:৩)। আর যুদ্ধে, দূরবর্তী এলাকায়, অথবা সামাজিক প্রয়োজনে দ্বিতীয় বিবাহ করা যদি শরিয়তের পরিসরে হয়, তবে তা একজন আলেম বা মুজাহিদের জন্য লজ্জার কিছু নয়, বরং দায়িত্বশীলতা ও নিরাপত্তার নজির হতে পারে। শহীদের চরিত্র কলঙ্কিত করার জন্য এসব প্রচারণা অনৈতিক ও তথ্যগতভাবে ভঙ্গুর। আজ প্রয়োজন, শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.)-এর লেখা ও জীবনকে নতুনভাবে পাঠ করা-বিন্যস্ত নয়, খণ্ড নয়, বরং সমন্বিতভাবে। তিনি ছিলেন এক সাহসী আত্মত্যাগী, যিনি কলম ও তরবারি উভয়কেই ঈমান রক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। “যে সংগ্রামে শাহাদাত হয়েছে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.), তা ছিল আত্মিক জিহাদ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার মিশ্রণ-কোনো কট্টর মতবাদের প্রতিফলন নয়। ইতিহাসের অপভ্রংশ তাকে যেভাবে ‘ওহাবী’ বানিয়েছে, তা আত্মিক রাজনীতির এক গভীর ষড়যন্ত্র।”
লেখক: কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
সাহিত্যিক, গবেষক, ও আন্তঃধর্মীয় বিশ্লেষক
বিআলো/তুরাগ