ফখরুল মুহাদ্দিসীন সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (র.)’র জীবন ও কর্ম
ফখরুল মুহাদ্দিসীন সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (র.)’র জীবন ও কর্ম
মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ বাংলাদেশের একটি সুপ্রাচীন আধ্যাত্মিক শিক্ষা কেন্দ্র। এ জায়গাটি সকল সুফিয়ানে কেরামের কাছে পরম ভক্তি নিবেদনের জায়গা। এ দরবারের প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ হলেন ফখরুল মুহাদ্দিসীন, পীরে তরিক্বত, শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (র.)। জন্ম ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ। পিতা মাওলানা সৈয়দ মতিউল্লাহ্ (র.) এবং মাতা হজরত খাইরুন্নেসা বিবি (র.)। গ্রাম্য পাঠশালা থেকে লেখাপড়া শেষ করে ১৮৪৪ সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে প্রতিটি পরীক্ষায় ও বিভাগে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। দরসে নিজামীর মাধ্যমে তফসির, হাদিস, ফিকাহ্ ও দর্শন শাস্ত্র অধ্যয়ন পূর্বক ‘ফখরুল মুহাদ্দিসীন’ উপাধিতে ভূষিত হন। কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় অধ্যয়নকালে (১৮৪৪-১৮৫১)-এ মহান আধ্যাত্মবিদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করেন, গাজীয়ে বালাকোট, শাহ সুফি নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী (র.)। সুফি নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী (র.)- কলকাতা পশ্চিম মিরীগঞ্জ নির্মিত মসজিদ-ই তৈয়ব (কলীন স্ট্রীট)-এর কামরায় থাকতেন। সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (র.) এবং সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসি (র.) ছিলেন সমসাময়িক আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। এ দু’জন মহান অলি-আল্লাহর মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে শরিয়ত ও তরিক্বতের সুবিশাল খেদমত সাধিত হয়েছে। ভাষাগত দক্ষতা ও ব্যুৎপত্তিগত জ্ঞানের দিক দিয়ে তিনি যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। যেসকল ভাষার উপর তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল, তন্মধ্যে- ১. বাংলা, ২. আরবি, ৩. ফারসি, ৪. উর্দু। যেসব বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন, ১. তফসির, ২. হাদিস, ৩. ফিকাহ (আইন শাস্ত্র), ৪. মানতিক, ৫. বালাগাত (অলঙ্কার শাস্ত্র), ৬. ফরায়েজ, ৭. ফিলোসফি, ৮. আকাঈন শাস্ত্র, ৯. তাসাউফ, ১০. ইলমে মারিফত।
প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন শেষ করে সর্বপ্রথম কলকাতা আলিয়া মাদরাসার দরসে নিজামীতে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৮৫২ সালে যশোর জেলার কাজী পদে বছর খানিক চাকরি করেন। পরবর্তীতে চাকরি থেকে ইস্তফা নিয়ে ১৮৫৩ সালে কলকাতা মেটিয়াবুরুজের মুন্সী বোয়ালী মাদরাসার প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। বায়’আত গ্রহণ করে গাউছিয়াতের ফয়েয হাসিল পূর্বক কামালিয়াতের মাক্বাম লাভ করেন, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত শায়খ সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ লাহোরী আল-কাদেরি (র.)’র কাছ থেকে এবং তাওয়াজ্জুহে এত্তেহাদি ও কুতুবিয়তের ফয়েজ হাসিল করেন, সৈয়দ দেলাওয়ার আলী পাকবাজ (র.)- থেকে। এ হিসেবে সৈয়দ দেলাওয়ার আলী পাকবাজ (র.) হলেন তার পীরে তাফাইয়ুজ। কাশ্ফ ও কারামত প্রকাশ করা শরিয়তে নিষিদ্ধ, তবে প্রয়োজন বিশেষ প্রকাশযোগ্য। সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (র.)-এর কাশ্ফ ও কারামত সম্পর্কে সকল তাসাউফপন্থি মোটামুটি অবগত। তবে পাঠকের জন্য বিশেষ দু’টি ঘটনা উল্লেখ করছি। ঘটনাটি বুঝার সুবিধার্থে পাঠকের উদ্দেশে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরছি।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রামে মাদরাসা শিক্ষা-ব্যবস্থা কার্যক্রম চালু হয় ১৮৭৪ সালে। মাদরাসাটির নাম ছিল চট্টগ্রাম মোহসিনীয়া মাদরাসা (১৮৭৪-১৯২৭)। এটি বর্তমানে ‘হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ’ নামে পরিচিত। মুঘল আমলে এটির নাম ছিল পর্তুগিজ ভবন, ব্রিটিশরা ক্ষমতা দখল করে চট্টগ্রামে পর্তুগিজ ভবনের নাম পরিবর্তন করে ‘দারুল আদালত’ নামকরণে ১৭৬১ সালে বিচারকার্য শুরু করে। পরবর্তীতে ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ সরকার, লালদীঘি সংলগ্ন পরীর পাহাড়ের চূড়ায় আদালত এবং অন্যান্য সরকারি অফিস স্থানান্তর করে। চট্টগ্রাম হাটহাজারী উপজেলার অন্তর্গত মির্জাপুর ইউনিয়নের বড় মৌলানা খ্যাত শাহ সুফি মৌলনা সৈয়দ মছিহ্ উল্লাহ মির্জাপুরী (র.) থেকে বর্ণিত, একদা আমি (সৈয়দ মছিহ্ উল্লাহ) তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম শহরস্থ কাতালগঞ্জের মৌলানা বশির উল্লাহ সাহেবের মসজিদে প্রবেশ করি। আমি, সৈয়দ আহমদ উল্লাহকে (র.) মসজিদে আপাদমস্তক কাপড় আচ্ছাদিত ও মুরাক্বাবা অবস্থায় দেখতে পেলাম। আমাকে তিনি বললেন, ‘আমি নাছারাগণকে কালেক্টরী পাহাড় থেকে নামিয়ে দিলাম এবং তথায় এক কুরছি (চেয়ার) আপনাকে, এক কুরছি মৌলভী খোদা নওয়াজ, এক কুরছি মৌলভী সুফি আবদুল ওদুদ সাহেবকে প্রদান করলাম’। এ ভবিষৎ বাণীর ৮ বছর পর অর্থাৎ- ১৮৭৪ সালে ‘চট্টগ্রাম মোহসিনীয়া মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠা হয় এবং মৌলনা সৈয়দ মছিহ্ উল্লাহ উক্ত মাদরাসার প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এখান থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৫৭ সালে সরকারি অফিস-আদালত লালদীঘির পরীর পাহাড়ে স্থানান্তরিত হয়। আর ১৮৫৭-১৮৭৪ সাল পর্যন্ত এ দারুল আদালত ভবন ছিল ভয়ংকর জি¦ন ভূত পরীর বাসস্থান। এ সমস্ত জি¦ন জাতিকে সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (র.) আধ্যাত্মিক প্রভাবের মাধ্যমে সেখান থেকে বিতাড়িত করে এবং সেখানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তার দোয়া কবুল করেন। আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম সংক্ষেপে হাটহাজারী মাদরাসা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় অবস্থিত একটি কওমি মাদরাসা। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রাচীন কওমি মাদরাসা। প্রতিষ্ঠা সাল ১৯০১।
‘নাদওয়াতুল মোকাল্লেফিন’ গ্রন্থে মৌলভী নজির আহমদ বর্ণনা করেন, একদা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (র.) বর্তমান হাটহাজারী মাদরাসার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি বললেন, ‘এঁহা কোরান আওর হাদিস কি খুশবু নেকাল রাহী হ্যায়’। অর্থাৎ- এখান থেকে কুরআন ও হাদিসের সুঘ্রাণ বের হচ্ছে। অতঃপর উক্ত স্থানের চতুষ্পার্শ¦ হেঁটে সীমানা নির্ধারণ করলেন। সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (র.)’র হায়াতে জিন্দেগী ছিলো- আমলে, আখলাকে, সুন্নতে, রিয়াজতে পরিপূর্ণ। তিনি খুবই বিচক্ষণ, উদার ও দয়ালু প্রকৃতির ছিলেন। তার হাত ও জবান আল্লাহর কাছে এতই মকবুল ছিল যে, তিনি কোনো বিষয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলে তা আল্লাহর দরবারে সঙ্গে সঙ্গে কবুল হয়ে যেত। তার ইশক, হাল, যযবা, জজব, কুরবতের অপূর্ব স্বর্গীয় ক্রিয়াকলাপ বা নিদর্শনগুলো সত্য অনুসন্ধানীদের পথ দেখাত এবং লোকজনের মধ্যে ঐশ্বরিক প্রেম ও জাগরণ সৃষ্টি হতো। তার ফয়েয ও তাওয়াজ্জুহ- পবিত্র অন্তরের অধিকারী কোনো বান্দা ক্ষণিকের জন্য গ্রহণ করলে তার মধ্যে মারিফাতের দৃষ্টি সঞ্চারিত হতো। চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যসমূহের মধ্যে-নির্জনতা, অধ্যবসায়ী, প্রতিভাশালী, তাক্বওয়াবান, তাহাজ্জুদগুজারি, স্বল্পভাষী, স্বল্পাহারী, পবিত্রতা, মৃদুহাসি, মাজার দর্শন বা মাজার জিয়ারত, জিকিরে ইলাহি, দরুদ-ই মুস্তফা (দ.) এবং মুরাক্বাবা-মুশাহেদা ছিল তার দৈনন্দিন রুটিন। শত অর্থকষ্ট ও লাঞ্ছনা বঞ্চনার মধ্যে হজরত কেবলা পুরোপুরিভাবে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতেন। এমনকি পৈতৃক সম্পদের অংশ পর্যন্ত ভাইদের দিয়ে দিয়েছেন। বিলাসীতা ও সখিন জীবনযাপন অপছন্দ করতেন।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সমানভাবে দয়া ও দান-খয়রাত করতেন। ভক্ত-মুরিদানের হাদিয়াকৃত নজর-নেওয়াজ যৎকিঞ্চিত পরিবারের জন্য রেখে বাকীটুকু বন্ধুমহল, নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশীসহ সর্বপ্রকার সাহায্য প্রার্থীদের প্রদান করতেন। নারীদের অত্যধিক অলংকার ব্যবহার অপছন্দ করতেন। পর্দার ব্যাপারে কঠোর ছিলেন। ফজরের নামাজের পর তরিক্বতের অজিফা, দরুদ শরীফ ও নির্দিষ্ট নামাজ আদায়ের পর অনেক বেলা পর্যন্ত কুরআন তেলাওয়াত করতেন। জোহর ও আছর নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে ধর্মালোচনা করতেন। তার বয়ানের প্রভাবে মানুষের অন্তর মোমের মতো গলে যেত। এ মহান আধ্যত্মবিদ ১৯০৬ সালে ইন্তেকাল করেন। ১০ মাঘ প্রতিবছর ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে তার বার্ষিক ফাতিহা শরীফ পালিত হয়।
লেখক: কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
(গবেষক ও ব্যাংকার)
বিআলো/তুরাগ