ফরিদপুরে সয়াবিন তেলের সংকট, অতিরিক্ত দামে বিক্রি
সেতু আক্তার, ফরিদপুর: রমজানের আগেই ফরিদপুরে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। খুচরা বাজারে নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা হচ্ছে। দোকানিদের অভিযোগ সংকটের জন্য দায়ী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। কানাইপুরের পাইকারী ব্যবসায়ী গৌতম কুন্ডু জানান, প্রায় দুই মাস ধরে কোম্পানি থেকে সয়াবিন তেল পাচ্ছি না। বসুন্ধরা গ্রুপের ডিলার সুকুমার ভৌমিক জানান, একমাস আগে ডিপুতে সয়াবিন তেলের অর্ডার করেছি এখনও পাইনি। ডিপু থেকে তেল সরবরাহ করছে না। বসুন্ধরা গ্রুপের ফরিদপুর অঞ্চলের ডিপু ইনচার্জ শরিফুল ইসলাম জানান, আমাদের প্রোডাক্টশন আপাতত বন্ধ থাকার কারণে বাজারে তেল সরবরাহ করতে পারছি না। তবে রমজানের মধ্যে প্রোডাক্টশন চালু হবে কিনা সে বিষয়ে তার জানা নেই। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ফরিদপুরের সহকারী পরিচালক মো. মাহমুদুল হাসান জানান, গত শনিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে এ সংক্রান্তে এক প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। তিনি জানান, বর্তমান সয়াবিন তেল কোম্পানিগুলো অধিক মুনাফার আশায় তাদের প্রোডাক্টশন বন্ধ করে রেখেছেন। সেজন্য বাজারে তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। এই সুযোগে পাইকারি ব্যবসায়ীরা খুচরা ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে সয়াবিন তেলের সঙ্গে কম চাহিদার পণ্য নিতে বাধ্য করছেন। মিডিয়াকর্মীসহ পুলিশের সহযোগিতা পেলে রমজানের আগেই বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো। জানা যায়, গত জানুয়ারি মাসের চেয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রায় চারগুণ বেশি সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। আসন্ন রমজান মাস ঘিরে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বিশেষ করে রমজানে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছোলা, খেজুর, চিনি, মটর ডাল, সয়াবিন তেল ও ফলসহ পণ্য আমদানি হয়েছে গত বছরের তুলনায় চারগুণ বেশি। অথচ ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন দোকান ঘুরে সহজে সয়াবিন তেলের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রেতারা বলছেন, এসব তেল মজুত করে রাখা হয়েছে। দাম বাড়ানোর জন্য এই কাজ করেছে অবৈধ সিন্ডিকেট।
গতকাল সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) ফরিদপুর জেলার কানাইপুর ও কাদিরদী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই। কোম্পানিগুলো তেল সরবরাহ করছে না বলে জানিয়েছেন দোকানিরা। বিভিন্ন ক্রেতারা বলেন, সব মুদি দোকানেই বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি করা হয়, এখন অধিকাংশ দোকানেই সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কোন কোন দোকানে পাওয়া গেলেও তা নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এ সুযোগে খোলা তেলের দাম বেড়ে গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল খালাস হয়েছে দুই লাখ ৩২ হাজার টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৯ শতাংশ বেশি। সয়াবিন বীজের আমদানিও বেড়েছে। গত জানুয়ারিতে সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে তিন লাখ টন, যা গত এক বছরে এত বেশি সয়াবিন বীজ আমদানির রেকর্ড নেই।
কানাইপুর বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, রমজান ঘিরে যেসব নিত্যপণ্য আমদানি হয়েছে, তাতে কারসাজি না হলে কোনও পণ্যের সংকট হবে না। এমনকি দাম বাড়ার পরিবর্তে আরও কমে আসবে। কিন্তু ভোজ্যতেল সরবরাহকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তেল আমদানি করে মজুত করে রেখেছে। বাজারে ছাড়ছে না। এজন্য সংকট দেখা দিয়েছে। তারা রমজানের আগে তেলের দাম বাড়ানোর জন্য সিন্ডিকেট করে বসে আছে।
আরও জানা যায়, এবার বন্দর দিয়ে গত জানুয়ারি মাসে ছোলা আমদানি হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৩০৪ টন যা গত বছরের জানুয়ারিতে আমদানি হয়েছিল ৬৬ হাজার ৩০ টন, সব ধরনের মটর ডাল ৯৫ হাজার ৭৮৮ টন, গত বছর আমদানি হয়েছিল আট হাজার ৮৭৩ টন, মসুর ডাল ৯০ হাজার ৬০৩ টন, গত বছর আমদানি হয়েছিল ৪৯ হাজার ১৪২ টন। পাশাপাশি চলতি বছরের জানুয়ারিতে চিনি আমদানি হয়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার টন, মুগ ডাল আমদানি হয়েছে ৩৬২ টন, সরিষা আমদানি হয় ৪৮ হাজার ৫৭৭ মেট্রিক টন।
রমজানে ইফতারে ফলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তাজা ফলের মধ্যে জানুয়ারিতে আপেল আমদানি হয়েছে ১১ হাজার ২০৪ টন, কমলা ও মাল্টা আমদানি হয়েছে ১০ হাজার ৩৯৬ টন, আঙুর এক হাজার ৫০৮ টন, নাশপাতি ২৫২ টন, খেজুর ১৪ হাজার ৮৪৯ টন ও আলুবোখারা ১৪৪ টন। একইভাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে (জুলাই-২০২৪ থেকে জানুয়ারি-২০২৫ পর্যন্ত) সাত মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে আপেল আমদানি হয়েছে ৬৪ হাজার ৫৭ টন, কমলা ও মাল্টা ৮০ হাজার ৩৬ টন, আঙুর ২৮ হাজার ৬৫৩ টন, নাশপাতি দুই হাজার ৬৬১ টন, খেজুর ২০ হাজার ৭৭৬ টন, আলুবোখারা এক হাজার ৩০১ টন, মসুর ডাল তিন লাখ ১৬ হাজার ২২৮ টন, মুগ ডাল আট হাজার ২২৩ টন, সব ধরনের মটর ডাল চার লাখ ৮৩ হাজার ২৭২ টন, মাষকলাই ডাল ১২৫ টন, ছোলা এক লাখ ৪৩ হাজার ৬৬২ টন, সরিষা দুই লাখ ১৩ হাজার ৮১২ টন, সয়াবিন তেল নয় লাখ ৭৪ হাজার ৯৯ টন ও এলাচ এক হাজার ১৯৯ টন। কাদিরদী বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী আনন্দ দেবনাথ জানিয়েছেন, রবিবার প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা, মসুর ডাল ১০৫ থেকে ১১০ টাকা, চিনি ১২০টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৮০-১৯০ টাকা, পেঁয়াজ ৪০ টাকা ও রসুন প্রতি কেজি ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা। আদা ১০০ টাকা। পাইকারিতে ছোলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকা, দেশি মসুর ডাল ১০০ টাকা ও চিনি ১২০ টাকা। এবার আড়তে পর্যাপ্ত পণ্যের মজুত আছে। সংকটের কোনও সম্ভাবনা নেই। এখন আমদানি অব্যাহত আছে। তবে তেলের সংকট আছে। ভোজ্যতেল সরবরাহকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মতো তেল দিচ্ছে না। এবার রমজান উপলক্ষে নিত্যপণ্য কম বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য বছর এই সময়ে পণ্য বিক্রির জন্য দম ফেলার সময় থাকতো না। এবার ক্রেতা কম। তাই বিক্রিও কম।