বড় ভূমিকম্প: মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত ফায়ার সার্ভিস
অ্যাপ চালু করার কথা ভাবা হচ্ছেঃ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
প্রশিক্ষিত ভলান্টিয়ারের সংকট
আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণের অভাব
একসঙ্গে ২৫ ভবনের নিরাপত্তার সক্ষমতা
রতন বালো: অবিরত ভূমিকম্পে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই রাতের বেলায় ঘুমাতে ভয় পাচ্ছেন, আবার কেউ বাসাবাড়ির নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। ভূমিকম্প প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় জনসাধারণের মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে বড় মাত্রায় ভূমিকম্প হলে ঢাকায় হতাহতদের উদ্ধার ও ভূমিকম্প পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুতি রয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের? সেই প্রশ্ন সামনে আসছে।
সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উদ্যোগে ভূমিকম্প, অগ্নিদুর্ঘটনা ও অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের লক্ষ্যে গঠিত স্থায়ী বিশেষজ্ঞ প্যানেল-এর সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে ভূমিকম্পে সরকারি ভবনগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা। গত ৪ ডিসেম্বর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে পরপর বেশ কয়েকটি ভূমিকম্পে জনমনে বৃদ্ধি পেয়েছে ভয়-আতঙ্ক। গত ২১ নভেম্বর ৫ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। এরপর ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো ছয়বার হালকা ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ভূমিকম্পগুলোর বেশিরভাগেরই উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদী অঞ্চল। একই এলাকায় বারবার ভূমিকম্প হওয়ায় বিশেষজ্ঞরাও বিষয়টি নিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে গত ২৩ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ভূমিকম্প নিয়ে সবাইকে একটু সতর্ক থাকতে হবে। অনেক দেশে ভূমিকম্প বিষয়ক অ্যাপ আছে। আমরাও চিন্তা-ভাবনা করছি এমন একটা অ্যাপ চালু করা যায় কি না।
দেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প নিয়ে প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা বাড়িঘর তৈরি করার সময় বিল্ডিংকোড যেন সবাই মেনে চলি। বিল্ডিংকোড না মেনে চললে ভবিষ্যতে আরো পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমরা জলাশয়গুলো ভরে বিল্ডিং করে ফেলি। একটা ভূমিকম্প হওয়ার পরে নিচে মানুষ মাঠে দাঁড়াবে সেই মাঠও নেই। এগুলোর দিকে রাজউকসহ সবাই যেন একটু খেয়াল করে।
এদিকে ভূমিকম্প প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় জনসাধারণের মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে বড় মাত্রায় ভূমিকম্প হলে ঢাকায় হতাহতদের উদ্ধার ও ভূমিকম্প পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুতি রয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের? সেই প্রশ্ন সামনে আসছে। বেশি ঝুঁকিতে সরকারি ভবন: ভূমিকম্পে সরকারি কার্যালয়গুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে দেশের সকল ফায়ার স্টেশনকে সবার আগে ভূমিকম্প সহনীয় করে তৈরি বা মেরামত করার আহ্বান জানানো হয়। শহরকেন্দ্রিক ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনে জায়গা পাওয়া না গেলে বিভিন্ন সরকারি ভবনের নিচের দ্বিতীয় তলা ফায়ার স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে বলেও পরামর্শ দেওয়া হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে দাবি করা হয়েছে ভূমিকম্পে সব চেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে সরকারি স্থাপনা। বিশেষজ্ঞগণ এশিয়াসহ অন্য উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ও জনবলের অপ্রতুলতার কথা উল্লেখ করেন। গ্যাপ এরিয়া ও এলাকাভিত্তিক ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের বিদ্যমান সক্ষমতা আরো বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়। ওয়াসার সকল পাম্প স্টেশনে ফায়ার সার্ভিসের ব্যবহারের জন্য ফায়ার ব্রিগেড কানেকশন স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন দুর্যোগের বিষয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি মূল্যায়ন পরীক্ষায় সহশিক্ষা কর্মসূচি হিসেবে নম্বর যুক্ত করা, আবাসিক এলাকা থেকে জরুরি ভিত্তিতে রাসায়নিক গোডাউন সরানো ও বিভিন্ন পর্যায়ে মহড়া ও প্রশিক্ষণ চলমান রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। দেশের সামগ্রিক জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘স্থায়ী বিশেষজ্ঞ প্যানেল’ ভবিষ্যতে নিয়মিতভাবে পরামর্শ, গবেষণা এবং নীতিমালা প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে।
মোকাবিলায় কতটা সক্ষম ফায়ার সার্ভিস?
গত ২১ নভেম্বর ভূমিকম্পের সময় তাড়াহুড়া করে হল থেকে নিচে নামার সময় আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ শিক্ষার্থী। এ তথ্য নিশ্চিত করে ফায়ার সার্ভিস বলছে, বড় আকারে ভূমিকম্প হলে কোনো দেশের ফায়ার সার্ভিসেরই এককভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তবে পর্যাপ্ত ভলান্টিয়ার প্রস্তুত করছে ফায়ার সার্ভিস। ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ মোকাবিলার স্বার্থে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ফায়ার সার্ভিসের ডিরেক্টর ট্রেনিং ও ডেভেলপমেন্ট বিভাগকে ঢাকার অদূরে পূর্বাচলে নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ঝুঁকি বিবেচনায় চলতি বছরের মে মাসে ফায়ার সার্ভিসের অপারেশনাল বিভাগকে ঢাকার মিরপুরে স্থানান্তর করা হয়েছে যাতে করে বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো যায়।
‘সারাদেশে ফায়ার সার্ভিস এখন পর্যন্ত ৫৫ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করেছে। ঢাকাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় রাজধানীতে ভলান্টিয়ার তৈরি কার্যক্রম আরো জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে স্পেশাল সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ টিম, যারা ধসে পড়া ভবনের ভেতরে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানে বিশেষ দক্ষ।’ এছাড়া উদ্ধার সহায়তায় ‘কুইক রেসপন্স’ করতে ৬০ সদস্যের ‘ স্পেশাল ফোর্স’ গঠন করা হয়েছে। ঢাকার বাইরেও প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ২০ জনের একটি করে ‘ স্পেশাল টিম’ প্রস্তুত করা হয়েছে যারা বিশেষভাবে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে উদ্ধার অভিযানের জন্য প্রশিক্ষিত।
সক্ষমতায় একসঙ্গে ২০-২৫টি ভবন : উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের যে ধরনের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন, সে ধরনের যন্ত্রপাতি সংস্থাটির নেই। তাদের জনবল সংকট ও প্রশিক্ষণের অভাব বেশ প্রকট। একসঙ্গে ২০-২৫টি ভবনের বেশি ভবনে কাজ করার সক্ষমতা তাদের নেই, আরবান কমিউনিটি ভলান্টিয়ারের (স্বেচ্ছাসেবক) সংখ্যাও কম। যদিও যেকোন দুর্যোগে ফায়ার সার্ভিসই একমাত্র ভরসা। ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, ঘূর্ণিঝড়, পাহাড় ধস সব জায়গায়ই তাদের দেখা যায়। কিন্তু জনবলের কমতির কারণে ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে প্রায়ই বেকায়দায় পড়তে হয় সংস্থাটিকে। রাজধানীতে বা বিভাগীয় শহরগুলোতে ১০ থেকে ১৫ গুণ বেশি মানুষের বসবাস। দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধারের কাজে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফায়ার স্টেশন বা জনবল নেই। ফায়ার সার্ভিস বলছে, মেগা ভূমিকম্প হলে কোনো দেশের ফায়ার সার্ভিসেরই এককভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয় না। তবে পর্যাপ্ত ভলান্টিয়ার প্রস্তুত করছে ফায়ার সার্ভিস।
ভূমিকম্পের ফলে যা ঘটে: ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বকে অসংখ্য ফাটল এবং চ্যুতির সৃষ্টি হয়। কখনো এতে সমুদ্রতলের অনেক স্থান উপরে ভেসে ওঠে। কখনো স্থলভাগের অনেক স্থান সমুদ্রতলে ডুবে যায়। অনেক সময় নদীর গতি পরিবর্তিত বা বন্ধ হয়ে যায়। ভূমিকম্পের ঝাকুনিতে পর্বতগাত্র থেকে বড় বড় বরফখণ্ড হঠাৎ নিচে পতিত হয় এবং পর্বতের পাদ দেশে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ভূমিকম্পের ধাক্কায় সমুদ্রের পানি তীর থেকে নিচে নেমে যায় এবং কিছু পরে ভীষণ গর্জন সহকারে ১৫-২০ মিটার উঁচু হয়ে ঢেউয়ের আকারে উপকূলে এসে আছড়ে পড়ে। এ ধরনের জলোচ্ছ্বাসকে সুনামি বলে। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভূকম্পনের ফলে সৃষ্ট সুনামির আঘাতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, থাইল্যাণ্ড, ভারত প্রভৃতি দেশে ব্যাপক জান-মালের ক্ষতি হয়। ভূমিকম্পের ফলে কখনো উচ্চভূমি সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত হয়। আবার কখনো সমুদ্রের তলদেশের কোনো স্থান উঁচু হয়ে সমুদ্রে দ্বীপের সৃষ্টি করে। ভূমিকম্পের ঝাকুনিতে ভূ-পৃষ্ঠে অনুভূমিক পার্শ্বচাপের প্রভাবে কুঁচকে ভাঁজের সৃষ্টি হয়। ভূমিকম্পের ফলে পার্বত্য অঞ্চল থেকে ধস নেমে নদীর গতি রোধ করে হ্রদের সৃষ্টি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দুর্ভিক্ষ-মহামারিতে বহু প্রাণহানি ঘটে। ভূমিকম্পে রেলপথ, সড়কপথ, পাইপ লাইন প্রভৃতি ভেঙে যায় এবং যাতায়াত ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। টেলিফোন লাইন, ভূমিকম্প সংঘটিত হলে ভূ-পৃষ্ঠের বড় বাধ, কালভার্ট, সেতু প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও অনেক সময় সুনামির সৃষ্টি হয়।
বিআলো/তুরাগ



