বর্তমান প্রজন্মের গ্রাম থেকে শহরে ছুটে আসার কারণ : এক বিরহের গল্প
গ্রামের অচেনা পথে, এক অপার শান্তির মাঝে যে জীবনের সুর বাজত, আজ সেই সুরকে হারিয়ে সন্ধান করছে নগরের কোলাহলে। এক সময় যেখানে বাঁশঝাড়, মাঠ, পুকুর, গরু-মহিষের পাল, নদী আর ঘর বাড়ির ছোট ছোট গোলামি-এসবই ছিল জীবনের অমূল্য সঙ্গী, সেখানে এখন শুধু নিঃসঙ্গতার কোলাহল। আজকের প্রজন্ম কেন গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে ছুটছে? কেন তারা ছেড়ে আসছে সেই সব সোনালী দিন, যেখানে সূর্যের আলোতে সোনালি ধান, কৃষকের হাঁসফাঁস হাসি এবং রাতের চাঁদের আলোতে খেলা ছিল জীবনের এক অনির্বাণ রূপ?
১. নগরের আলোয় উদ্দীপনা, গ্রামে একাকী জীবন
গ্রামে জীবন ছিল চিরন্তন নিরিবিলি, কিন্তু আধুনিক যুগের গ্রামীণ জীবনে কোনো অনুপ্রেরণা নেই, কোনো উদ্দীপনা নেই। দিনের পর দিন একে একে জমি চাষ, পাখির কোলাহল, মাটির গন্ধ আর সবুজ মাঠের একঘেয়েমি-এটি এখন নতুন প্রজন্মের কাছে এক ধরনের অবসর, তাদের মনোরঞ্জন নয়। তারা চায় জীবনকে আরো গতিময় এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে। শহরের হোন্ডা, সোনালী ভবন, দোকানপাট আর আধুনিক প্রযুক্তি তাদের আকৃষ্ট করে, কারণ এখানে প্রতিটি মুহূর্তে নতুন কিছু শেখার সুযোগ থাকে। যেখানে একদিকে শাস্তি আর সংগ্রাম, অন্যদিকে সুযোগ আর উত্তরণের উজ্জ্বল রঙ।
২. প্রযুক্তির দখলে গ্রাম থেকে নগরের পথ
আধুনিক যুগে প্রযুক্তির দ্রুত বৃদ্ধি গ্রামাঞ্চলকে কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে। গ্রামে এখনো অনেক জায়গায় ইন্টারনেট সেবা নেই, এবং শহরের তুলনায় অনেক পরিষেবা অসম্পূর্ণ। শিক্ষার জন্য শহরেই থাকা প্রয়োজন, কারণ এখানে শুধু স্কুল বা কলেজই নয়, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গবেষণাগার সবকিছুই শহরের কেন্দ্রবিন্দু। গ্রামে বসে কি আর ডিজিটাল শিক্ষা, অনলাইন কোর্স বা আন্তর্জাতিক সুযোগ পাওয়া সম্ভব? এসব কিছু শহরেই মেলে। আর নতুন প্রজন্ম তাদের জীবনে সাফল্য, উচ্চ শিক্ষার সুযোগ এবং বিশ্বের সঙ্গে এক হয়ে বাঁচতে চায়। তাই শহরের পথ তারা বেছে নেয়, যেখানে শিক্ষার আকাশ উন্মুক্ত।
৩. অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা
গ্রামে এক সময় জীবন ছিল শান্ত, সহজ এবং পরিশ্রমী। কৃষক, শ্রমিক, মজুর-সবেই ছিল এক প্রকারের আস্থা, একতা। কিন্তু এখন এই জীবনযাত্রা আর যথেষ্ট টানে না। গ্রামে ফসল ফলানো, পণ্য উৎপাদন বা মাটি কামড়ানো শ্রমের বদলে, তরুণেরা চাইছে আধুনিক যুগের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। শহরের চাকরি, ব্যবসায়িক সুযোগ, শিল্পকলার জগৎ-এগুলোই এখন তাদের আকর্ষণ। শহরে এসে তারা আরো ভালো চাকরি, ভালো আয় এবং সামাজিক মর্যাদা অর্জন করতে চায়। গ্রামে তার জন্য সুযোগ সীমিত।
৪. সামাজিক প্রভাব : পুরোনো ঐতিহ্য বনাম নতুন জীবনধারা
গ্রামের জীবন ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে থাকে, যেখানে পারিবারিক ও সামাজিক চাপে জীবন বেশিরভাগ সময় অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। গ্রামাঞ্চলে ভালোবাসা, সম্পর্ক, বন্ধুত্ব সবই ছিল এক ঐতিহ্যবাহী সুরে বাঁধা, কিন্তু শহরে আসা তরুণরা চায় স্বাধীনতা, নিজের পছন্দের জীবনযাপন এবং ব্যক্তিগত উন্নতি। শহরের জীবনে তারা নিজের পরিচিতি তৈরি করতে চায়, যেখানে পূর্বস্মৃতি আর নৈকট্য চাহিদার চেয়ে এগিয়ে থাকে ব্যক্তিগত লক্ষ্য। শহরে এলে তারা চায় স্বাধীন হতে, তাদের মনের মতো জীবন গড়ে তুলতে।
৫. স্বপ্নের উচ্চতা : যেখানে সব কিছু সম্ভব
শহর হয়ে ওঠেছে এক স্বপ্নপুরী। সেখানে প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি ভবন, প্রতিটি টেকনোলজি যেন স্বপ্নের এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। তরুণরা জানে যে, এখানে অনেক কিছু শেখার, অর্জন করার সুযোগ রয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্যে সারা পৃথিবী তাদের হাতে, আর এর প্রভাব গ্রামে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে। এই কারণে, তাদের মনে শহরের প্রতি আকর্ষণ আরো বাড়ে। সেখানে শিল্প, প্রযুক্তি, ব্যবসা-সব কিছুতেই নতুন কিছু করার সুযোগ আছে। আর এ সুযোগকে তাদের কাছে ‘সাফল্যের চাবিকাঠি’ হিসেবে মনে হয়।
৬. স্বাস্থ্যসেবা : প্রয়োজনীয় সেবা শহরেই
এছাড়া, শহরে স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত উন্নত। গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা অনেক সময় হয় না, কিংবা সময়মতো চিকিৎসক পাওয়া যায় না। তবে শহরের হাসপাতালগুলোতে উন্নত যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা সহজেই পাওয়া যায়। এই কারণে, বিশেষ করে তরুণরা শহরের দিকে ছুটে যায়, যেখানে তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই। গ্রামে কিছু জরুরি সেবা ও সুযোগের অভাব তাদের শহরের দিকে আকৃষ্ট করে।
উপসংহার :
এখনকার প্রজন্ম আর গ্রামে নেই, শহরের দিকে ছুটে চলছে। গ্রামীণ জীবনের সেই সোনালী দিনের স্মৃতি হয়তো তাদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে, তবে তারা জানে-তাদের সপ্নের দিগন্ত শহরের দিকে। শহর তাদের জন্য নতুন জীবন, নতুন সুযোগ, আর নতুন উদ্দীপনার জগৎ। কিন্তু, গ্রাম তো কখনোই হারিয়ে যাবে না, সেটা তাদের মনের অন্ধকার কোণে এক হালকা আলো হয়ে জ্বলতে থাকবে। কারণ, গ্রামে তাদের শেকড়, তাদের হৃদয়ের গহন প্রান্তর, যেখানে তারা ফিরে গিয়ে শ্বাস নিতে চায়, এই জীবনের গতি আর কোলাহলের মাঝে।
- লেখক :-কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
- ব্যাংকার ও গবেষক
- বিআলো/এফএইচএস