“বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ইসলাম নিষিদ্ধ জাতীয়তাবাদ নয়”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উপস্থাপিত “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” ইসলামে নিষিদ্ধ জাতীয়তাবাদের অন্তর্ভুক্ত নয় বলেই মনে করি।
এই দর্শন কোনো উগ্র বা বিভাজনমূলক জাতীয়তাবাদ নয়; বরং এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিচয়বাদ, যা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে এক ও অভিন্ন পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে।
ইসলামে যে জাতীয়তাবাদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা হলো আসাবিয়্যাহ—নিজের জাতি, গোত্র, বংশ বা ভাষাকে অন্যদের ওপরে স্থান দেওয়া, বৈষম্য করা এবং বিভাজন সৃষ্টি করা। “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” এই ধারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে কোনো জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব নেই; বরং ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের মধ্যেও এক অভিন্ন পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে—তা হলো বাংলাদেশী পরিচয়।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” ইসলামে নিষিদ্ধ জাতীয়তাবাদ নয়; বরং তা একটি রাষ্ট্রভিত্তিক অভিন্নতা, যা সবাইকে একত্রিত করেছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ ছিল একটি নতুন রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একটি অভিন্ন পরিচয়, যা ভেতরের ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়কে একত্রিত করবে।
আওয়ামী লীগের বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ মুক্তির সংগ্রামে কার্যকর ভূমিকা রাখলেও স্বাধীনতার পর তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। কারণ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী বা অমুসলিম সম্প্রদায়ের পরিচয়কে পুরোপুরি ধারণ করতে পারেনি।
এই প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান একটি নতুন রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” উপস্থাপন করেন। এটি ভাষা নয়, বরং রাষ্ট্রভিত্তিক পরিচয়ের উপর দাঁড় করানো হয়—যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ বাংলাদেশ নামের অভিন্ন পতাকার নিচে ঐক্যবদ্ধ হয়।
তারেক রহমানের ভাষায়—“একটি রাজনৈতিক দলের পুঁজি হলো জনগণ, আর সেই দলের লক্ষ্য ও আদর্শ হলো জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা।”
ইসলামী রাজনীতির মৌলিক নীতি আমানতদারিতার সাথেও এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ।কারণ শাসন হলো জনগণের প্রতি একটি আমানত।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ শুধু রাষ্ট্রভিত্তিক পরিচয় নয়, বরং এটি এক ধরনের মুসলিম জাতীয়তাবাদও বটে—তবে সেটা ধর্মীয় একমাত্রিকতায় নয়, বরং সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত বাস্তবতার মিশেলে আবির্ভূত হয় ।
বাংলার মুসলিম সমাজ ১২০৪ সাল থেকে একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যাত্রা করেছে। মোগল আমল থেকে পাকিস্তান আন্দোলন পর্যন্ত মুসলিম জাতিসত্তা এ অঞ্চলের রাজনৈতিক চেতনাকে প্রভাবিত করেছে। জিয়াউর রহমান সেই ইতিহাসকে অস্বীকার না করে, বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্রে তার ধারাবাহিকতাকে স্বীকৃতি দেন।
আওয়ামী লীগের সেক্যুলারিজমে
ধর্মকে পুরোপুরি জনজীবন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমান তা সংশোধন করে বলেন—ধর্ম এ দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে তিনি সংবিধানে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও মুসলিম ঐতিহ্যকে স্থান দেন, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পরিচয়কে প্রতিফলিত করে।
জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ মুসলিম পরিচয়কে রাষ্ট্রের মূল ধারায় প্রতিষ্ঠিত করলেও, অমুসলিমদের বঞ্চিত করেনি। বরং অমুসলিমরাও “বাংলাদেশী” পরিচয়ে সমান মর্যাদা পায়। এটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ মডেল—যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়, আবার সংখ্যালঘুরাও সুরক্ষিত থাকে।
জিয়াউর রহমান ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (OIC)-তে বাংলাদেশকে যুক্ত করেন এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক জোরদার করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা জাতীয়তাবাদকে একটি বৃহত্তর মুসলিম পরিচয়ের সাথে যুক্ত করে।
অনেকের কাছে “জাতীয়তাবাদ” মানে জাতিগত উগ্রতা। কিন্তু “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” আসলে একটি পরিচয়বাদ (Identity-based unity)। এর মাধ্যমে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী থেকে শুরু করে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই নিজেদেরকে প্রথমত বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে অভিন্ন পরিচয়ে আবদ্ধ দেখতে পায়।
অতএব একে কঠোর অর্থে জাতীয়তাবাদ না বলে বরং বাংলাদেশপন্থা বলা অধিক যথাযথ। কারণ এখানে সবার আগে বাংলাদেশ। এখানে, ধর্ম, গোত্র বা ব্যক্তিগত পরিচয় মুখ্য নয় । কিন্তু গনতান্ত্রিক কাঠামোগতভাবেই ইসলাম এখানে প্রাধান্য পায়।
মো: মুখলেছুর রহমান
সমাজ চিন্তক, ইসলামী অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
বিআলো/ইমরান