বাউল সমাজ এখনো ফ্যাসিবাদের ছায়ায় বন্দী?
এফ এইচ সবুজ।। বাউল সমাজে পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ রাজনীতির প্রভাব যেন এখনো কাটেনি। মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের ‘আশীর্বাদপু’ বাউল শিল্পী মুক্তা সরকার আজও দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন ও স্টেজ প্রোগ্রামে সক্রিয়। অথচ ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্বাচনের সময় তার প্রকাশ্য রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এখনো অনেকের মনে তাজা হয়ে আছে।
একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়-সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম নিজ হাতে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন মুক্তা সরকারকে, আর মুক্তা স্নেহভরে তাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করছেন। অনেকের মতে, এই দৃশ্য শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রকাশ নয়, বরং বাউল সমাজে মমতাজ-মুক্তা জোটের সাংস্কৃতিক প্রভাব ও আধিপত্যের নগ্ন প্রতীক।
বলা হচ্ছে, বাউল সমাজ আজও সেই আধিপত্যের অন্ধকার থেকে বের হতে পারেনি।
ফ্যাসিস্ট সরকারের ডামি নির্বাচনের সময় মুক্তা সরকার প্রকাশ্যে রাজনৈতিক প্রচারণায় অংশ নিয়ে নেতা-কর্মীদের ‘মোনাফেক’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তার সেই বক্তব্য আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে-‘আপনারা সবাই ৭ তারিখ নৌকা মার্কায় ভোট দিবেন, আমার মা জননীকে জয়যুক্ত করবেন। আমি ৭ দিন গান রাখি নাই আমার মায়ের জন্য। আমরা আপনাদের গান শোনাবো, আমি মুক্তা সরকার কথা দিলাম। আর যারা মোনাফেক আছে তাদের একালায় ঢুকতে দিবেন না।’
একজন বাউল শিল্পীর মুখে এমন রাজনৈতিক আহ্বান-বাউল দর্শনের মুক্তচেতা, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী ভাবনার সঙ্গে কতটা মানানসই-সেই প্রশ্ন এখন বাউল সমাজের ভেতর-বাইরেই তীব্রভাবে উঠছে।
যে আওয়ামী লীগকে স্বৈরাচারী আচরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেই দলের প্রচারে থাকা বাউল শিল্পীর সম্পৃক্ততা এখন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও ফ্যাসিবাদের ছায়া ফেলে দিয়েছে।
ক্ষমতার পালাবদলের পরও যদি মুক্তা সরকার একইভাবে টেলিভিশন ও স্টেজে প্রভাব বজায় রাখেন, তবে কি বলা যায় না- বাউল সমাজ এখনো মমতাজের ছায়াতেই বন্দী?
বাউল গান ছিল একসময় প্রতিবাদের সুর, মুক্তচিন্তার আহ্বান ও মানবতার জয়গান। কিন্তু এখন কি তা পরিণত হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের প্রশস্তিগানে?
ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সংগীতশিল্পী বেবী নাজনীন রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন শোবিজ অঙ্গন থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। তিনি অভিযোগ করেন, গত ১৭ বছর কাজের সুযোগ না দেওয়ায় তার ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একইভাবে গায়ক আসিফ আকবরও একই পরিস্থিতির শিকার হন। সামাজিক মাধ্যমে তিনি লিখেছিলেন-‘আমি গান গেয়ে পাপ করেছি।’
এক সময়ের প্রতিবাদী সংগীতজগত আজ যেন নীরব, যেখানে শিল্পীর কণ্ঠ চেপে ধরে রাখা হয় ক্ষমতার ছায়ায়।
তাহলে কি বাউল পরিচয়ের নতুন সংজ্ঞা এখন-শিল্পী নয়, ক্ষমতার দোসর হওয়া?
বাউল সমাজের গলা চেপে ধরা এই সাংস্কৃতিক আধিপত্য আর কতদিন চলবে-সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
বাউল শিল্পী মালেক সরকার দৈনিক বাংলাদেশের আলো’কে বলেন-একজন রাজনীতিকের চেয়ে কি বাউলের সম্মান কম? কেন একজন বাউল রাজনীতি করতে যাবে? একজন সত্যিকারের বাউল কখনো রাজনীতির পথে যায় না। বাউল হওয়া কোনো পেশা নয়, এটা এক ধরনের গুণ-একটা আত্মিক সাধনা। যার মধ্যে সেই গুণটা নেই, সে বাউল হলেও নামেই বাউল।
আজকাল অনেকেই মনে করে এমপি বা রাজনৈতিক নেতা হলে অনেক কিছু পাওয়া যাবে। এই ভাবনাটা আসলে অজ্ঞতা ছাড়া কিছু না। আমাদের সমাজে এখন এমনও কিছু বাউল আছেন, যারা মনে করেন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে থাকলে নিজের অবস্থান বা আর্থিক অবস্থা উন্নত হবে। কিন্তু এটা এক বড় ভুল। রাজনীতির সঙ্গে মিশে বাউলের আত্মা হারিয়ে যায়।
বাউল হওয়া আর বাউল শিল্পী হওয়া এক নয়-একজন বাউল শিল্পী গান গাইতে পারে, কিন্তু বাউল হওয়া মানে আত্মার সাধনা, সত্য ও প্রেমের পথে থাকা।
আমাদের অভাব কাটছে না, কারণ আমরা নিজেরা নিজেদের বিক্রি করে দিচ্ছি টাকার লোভে। যেখানে আত্মসম্মান থাকা উচিত, সেখানে এখন লজ্জা-শরম কমে গেছে, অভাব আর লোভ বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ বাউল সমিতির চেয়ারম্যান আবুল সরকার দৈনিক বাংলাদেশের আলো’কে বলেন-মুক্তারে তো মমতাজ পেটের থেকে জন্ম দেয় নাই, আবার মমতাজ ওরে শিল্পীও বানায় নাই। ও তো নির্বাচনের সময় মমতাজের জন্য ভোট চাইতেই গেছে, গানে নয়। যেহেতু মমতাজকে মা বলে ডাকে, তাই মায়ের জন্য ভোট চাওয়া ওর কাছে স্বাভাবিক বিষয়। মুক্তা আওয়ামী লীগ করতো, তাই আওয়ামী লীগের কথাই বলেছে, গানও গেয়েছে। তবে আমরা বাউলরা সক্রিয় রাজনীতি করি না-সেটা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত বা জাতীয় পার্টি-কোনো দলের সঙ্গেই আমাদের প্রত্যক্ষ সংশ্লি’তা নেই।
আমাদের দর্শন হলো, ‘যে সময় যে সরকার, সে-ই আমার রাজা, আমি তারই পুজা করি। বাউলদের পথ রাজনীতির নয়, মানবতার।’
বাউল শিল্পী মুক্তা সরকার দৈনিক বাংলাদেশের আলো’কে বলেন-‘ওনার সঙ্গে আমার শুধু শিল্পীর সম্পর্ক, মমতাজ বেগমকে আমি কখনও রাজনৈতিক মা হিসেবে দেখি নাই। উনার সঙ্গে আমার শুধু শিল্পীর সম্পর্ক। উনি গান করেন, আমিও গান করি-এই সূত্রেই আমাদের সম্পর্ক। ছোটবেলা থেকে উনি আমার গান পছন্দ করেন।
তিনি আরও বলেন, রাজনীতির জন্য আমি ওনাকে ‘মা’ ডেকেছি-বিষয়টা একেবারেই সত্য নয়। আমি কি কোনো প্রার্থী? আমি কি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য? তাহলে রাজনীতির জন্য ওনাকে ‘মা’ ডাকব কেন! যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, আমরা শিল্পীরা সাধারণত সেই সরকারের কথাই বলি। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, তাই তাদের পক্ষে গান করেছি। মমতাজ বেগম তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন। শিল্পী হিসেবে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, রাজনীতির কারণে নয়। উনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেবল শিল্পীর, এর বাইরে আর কিছু নয়।’
বিআলো/এফএইচএস