বিপ্লব না গণঅভ্যুত্থান: বিভ্রান্তিমূলক প্রজ্ঞাপন কি বিভাজনের সূচনা করছে?
০১ জুলাই ২০২৫ তারিখে স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, যার বিষয় “আইডিয়া প্রস্তাব আহ্বান”। এতে তরুণদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানানো হয়েছে, “আমার চোখে জুলাই বিপ্লব” শিরোনামে ১ থেকে ২ পৃষ্ঠার একটি রচনা পাঠাতে। অথচ, একই প্রজ্ঞাপনে আবার বলা হয়েছে-ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে এই প্রতিযোগিতা আয়োজিত। এখানেই দেখা যাচ্ছে এক গুরুতর সাংগঠনিক ও দার্শনিক অসামঞ্জস্য।
প্রজ্ঞাপনের ভাষা অনুযায়ী, লেখা গণঅভ্যুত্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে-কিন্তু বিষয় “বিপ্লব”। প্রশ্ন জাগে—গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লব কি একই বিষয়? মোটেও না।
বিপ্লব বনাম গণঅভ্যুত্থান: মূল পার্থক্য- বিপ্লব সাধারণত একক নেতৃত্বে সংঘটিত রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিবর্তনের সহিংস রূপ। এটি সশস্ত্র বা কাঠামোগত রূপান্তরের মাধ্যম হয়ে থাকে। যেমন ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, কিউবার বিপ্লব, যেখানে লেনিন, চে গেভারা বা ফিদেল কাস্ত্রোর মতো নেতারা নেতৃত্ব দিয়েছেন।
অন্যদিকে, গণঅভ্যুত্থান হলো বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে স্বৈরাচার ও অন্যায় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। এর নির্দিষ্ট কোনো একক নেতা বা বিপ্লবী থাকে না, বরং রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক জোট ও সর্বসাধারণের সম্মিলিত অংশগ্রহণই এর বৈশিষ্ট্য।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া আন্দোলন, যার শুরু হয়েছিল কোটা বাতিল ইস্যুতে, এক পর্যায়ে তা দেশব্যাপী সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রূপ নেয় এবং শেষ পর্যন্ত একটি সরকারের পতনে রূপান্তরিত হয়। এটি একটি গণঅভ্যুত্থান। এর কোনো একক বিপ্লবী নেতা নেই, বরং সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ রয়েছে।
তাহলে কেন ‘আমার চোখে বিপ্লব’?
যেখানে আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল গণঅভ্যুত্থান, সেখানে সরকারিভাবে ‘বিপ্লব’ শব্দ প্রয়োগ করাটা বিভ্রান্তি সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি করে। এতে করে তরুণ প্রজন্ম যেমন দোদুল্যমান হয়ে পড়ে, তেমনি ইতিহাসের বিকৃতি ও মতানৈক্যের পথও উন্মুক্ত হয়।
বিশেষতঃ প্রজ্ঞাপনের একদিকে ‘জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান’ লিখে পরে ‘আমার চোখে বিপ্লব’ বলা এবং আবার লেখাকে ‘গণঅভ্যুত্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ’ করতে বলায় প্রশ্ন ওঠে—এটা কি প্রশাসনিক অমনোযোগ, না কি উদ্দেশ্যমূলক গা-ছাড়া ভাব?
সরকারের করণীয়:- প্রথমত, সরকারকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে-২০২৪ সালের জুলাইয়ের ঘটনাকে তারা কী হিসেবে গণ্য করছে: গণঅভ্যুত্থান, না বিপ্লব?
দ্বিতীয়ত, প্রজ্ঞাপন হালনাগাদ করে একটি নির্ভুল, ঐতিহাসিকভাবে সংবেদনশীল ও পরিস্কার দিকনির্দেশনা দিতে হবে, যেন অংশগ্রহণকারী তরুণরা বিভ্রান্ত না হন।
তৃতীয়ত, সরকারের উচিত শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে ভবিষ্যতের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাগুলোকে সংজ্ঞায়িত করা, যেন প্রজন্মের কাছে বিভ্রান্তিমূলক বার্তা না যায়।
একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ সরকারি প্রজ্ঞাপন কখনো কখনো একটি জাতিকে বিভক্ত করতে যথেষ্ট। “জুলাই গণঅভ্যুত্থান” নামে যেখানে একটি ঐতিহাসিক চেতনা গড়ে উঠছে, সেখানে সেটিকে ভুলভাবে ‘বিপ্লব’ আখ্যা দিয়ে ইতিহাস বিকৃতি বা রাজনৈতিক বিভাজনের জন্ম দেওয়া উচিত নয়।
আসুন, ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃত না করে তাকে সম্মান করি। আর তরুণদের হাতে সত্যনিষ্ঠ তথ্য তুলে দিই, যাতে তারা সঠিক মূল্যবোধ নিয়ে আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে এগিয়ে যেতে পারে।
লেখক- মোঃ ফরহাদ হোসেন বাবু
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বিআলো/এফএইচএস