বিশ্বজুড়ে ৫ কোটির বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত: আইএলও-ইউনিসেফ
এফ এইচ সবুজ: বৈশ্বিক নানা উদ্যোগের ফলে সামগ্রিকভাবে শিশুশ্রম কমলেও ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৩ কোটি ৮০ লাখ শিশু এখনো শিশুশ্রমে নিযুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫ কোটি ৪০ লাখ শিশু রয়েছে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে, যা তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও মানসিক বিকাশের জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করছে।
বৃহস্পতিবার (১২ জুন) আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)-এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘চাইল্ড লেবার: গ্লোবাল এস্টিমেটস ২০২৪, ট্রেন্ডস অ্যান্ড দ্য রোড ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন বিশ্ববাসীর সামনে একটি কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, বৈশ্বিক নানা প্রচেষ্টা ও আংশিক অগ্রগতি সত্ত্বেও এখনও প্রায় ১৩ কোটি ৮০ লাখ শিশু শিশুশ্রমে যুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে ৫ কোটি ৪০ লাখ শিশু এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত, যা তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও বিকাশকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।

বিশ্বব্যাপী সচেতনতা ও নীতিগত উদ্যোগ গ্রহণের পরও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এখনও লাখ লাখ শিশু তাদের শিক্ষা, খেলা ও শিশুসুলভ বেড়ে ওঠার অধিকার থেকে বঞ্চিত। এরা শিশু হয়েও বড়দের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্য, অপ্রতুল সামাজিক সুরক্ষা, এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব এই সমস্যার মূল চালিকাশক্তি। শিশুশ্রমের হার সবচেয়ে বেশি কৃষিখাতে (৬১%), এরপর সেবা খাতে (২৭%) এবং শিল্প খাতে (১৩%)।
প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে, শিশুশ্রমের হার কমাতে হলে নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা, এবং নিয়োগকর্তা ও সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। ইউনিসেফ ও আইএলও জোর দিয়ে বলেছে, এখনই সময় শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ শৈশব নিশ্চিত করার পথে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের।
প্রতিবেদনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শিশুশ্রম কমার চিত্র দেখা গেলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি সে রকম নয়। ২০১৩ সালে যেখানে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের হার ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৭ শতাংশে (প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু)। কিন্তু একই সময়ে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শ্রমে যুক্ত থাকার সামগ্রিক হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশে। ক্ষতিকর কাজে যুক্ত বৃহত্তর শিশুশ্রমের হার তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে—২০১৩ সালে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে সামান্য বেড়ে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে ২০২২ সালে। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, গত দুই দশকে বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়ায় কিছু উন্নতি হয়েছে, তবে বাংলাদেশ এখনও ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সঠিক গতিতে নেই। শ্রমে যুক্ত অধিকাংশ শিশু কাজ করছে অনানুষ্ঠানিক খাতে, যেখানে তারা দীর্ঘ সময় ধরে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই বাস্তবতা পরিবর্তনে বাংলাদেশে জরুরি প্রয়োজন স্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই প্রচেষ্টা।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, ‘এই বৈশ্বিক প্রতিবেদনের তথ্য ও বাংলাদেশে আমাদের নিজেদের পাওয়া তথ্য একইসঙ্গে উৎসাহ যোগায় এবং এই সংকট সমাধান করতে উদ্বুদ্ধ করে। ’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হ্রাসে অগ্রগতি আমরা স্বীকার করি, তবে সামগ্রিক শিশুশ্রমের হার একই রকম থাকায় এটি স্পষ্ট যে আমাদের আরও অনেক কিছু করার রয়েছে। একটি শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া জোরদার করতে হবে, সব শিশুর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার সার্বজনীন সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে এবং সমাজসেবা, বিশেষ করে শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। শিশুদের স্থান স্কুল ও খেলার মাঠে, কর্মক্ষেত্রে নয়। তাদের অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি জরুরি।
শিশুশ্রম শিশুর শিক্ষা ব্যাহত করে, তাদের অধিকার খর্ব করে এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে কমিয়ে আনে। এতে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। শিশুশ্রমের মূল কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য এবং মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব, যার ফলে পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হয় এবং সেই সঙ্গে বঞ্চনার বংশপরম্পরাগত চক্র স্থায়ী হয়ে যায়।
বিশ্বব্যাপী তথ্য অনুযায়ী, কৃষিখাত এখনও শিশুশ্রমের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র— শিশুশ্রমের ৬১ শতাংশ ঘটে এই খাতে। এরপরেই রয়েছে সেবা খাত (২৭ শতাংশ), যেমন- গৃহস্থালি কাজ বা বাজারে পণ্য বিক্রি এবং শিল্প খাতে রয়েছে (১৩ শতাংশ), যার মধ্যে খনি ও উৎপাদন শিল্প অন্তর্ভুক্ত।
বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসে আইএলও বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অফিসার-ইন-চার্জ) গুঞ্জন ডালাকোটি আইএলও কনভেনশন নম্বর ১৩৮ ও ১৮২ কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের গুরুত্ব তুলে ধরেন। আইএলও’র এই দুই কনভেনশন বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সমর্থন দিয়েছে। এগুলোর পাশাপাশি জাতীয় আইনগত কাঠামোর মাধ্যমে শিশুশ্রম নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। শিশুশ্রম নিরসনের অগ্রগতির স্থবিরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি একটি সামগ্রিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের মাধ্যমে পুনরায় প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, অর্থপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করতে হলে কমিউনিটি, নিয়োগকর্তা, শ্রমিক সংগঠন, সুশীল সমাজ, এনজিও ও সংবাদমাধ্যমের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আইএলও’র অব্যাহত সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, শিশুশ্রম থাকলে সেখানে যথাযথ শ্রমের পরিবেশ থাকে না। তিনি একই সময় প্রতিটি শিশুর জন্য একটি নিরাপদ শিক্ষার সুযোগ সংবলিত শৈশব নিশ্চিত করার জন্য সামগ্রিক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
বিআলো/সবুজ