বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ৮০তম জন্মদিন আজ
শাহাদাত হোসেন তালুকদার, সাকু: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও প্রথিতযশা ভূ-বিজ্ঞানী বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আজ বুধবার (১ অক্টোবর) তার ৮০তম জন্মদিনে পদার্পণ করেছেন। ১৯৪৬ সালের এই দিনে তিনি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গয়েশপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা, গবেষণা, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি ও সমাজ উন্নয়নে তাঁর অবদান দেশবাসীর কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।
শিক্ষাজীবনে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে তিনি ১৯৬২ সালে দাউদকান্দি হাইস্কুল থেকে মেট্রিক, ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আইএসসি এবং ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্বে এমএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করার পাশাপাশি উচ্চতর শিক্ষার জন্য কলম্বো প্লান স্কলারশিপে লন্ডনে যান। সেখানে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে এমএসসি (১৯৭০), ডিআইসি ডিপ্লোমা (১৯৭৩) এবং ১৯৭৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগে অধ্যাপনা করেন এবং ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভূতত্ত্ব গবেষণায় তাঁর উদ্ভাবিত “Hossain’s Method of Extension” আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিদেশে অবস্থানরত অবস্থায় তিনি বিলাত প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করে বিশ্বজনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর অবদান ইতিহাসের গর্বিত অংশ।
রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তিনি চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং তিন দফায় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রী, ১৯৯৬ সালে স্বল্পকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন। দায়িত্ব পালনকালে তিনি দাউদকান্দি পৌরসভা, তিতাস উপজেলা ও মেঘনা উপজেলা প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখেন। এ সময় স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক খাতে সহস্রাধিক কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেন। ২০০৩ সালে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫৭তম সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর সভাপতিত্বে গৃহীত হয় তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক Framework Convention on Tobacco Control (FCTC)। বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন এবং বিশ্বব্যাপী তামাকবিরোধী আন্দোলনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাঁকে “World No Tobacco Award” পদকে ভূষিত করে।
শুধু রাজনীতি নয়, সমাজ উন্নয়নেও তাঁর রয়েছে অসামান্য অবদান। নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত ড. মোশাররফ ফাউন্ডেশন এর মাধ্যমে তিনি শিক্ষা ও মানবকল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২টি কলেজ, ২টি হাইস্কুল, ১টি গার্লস হাইস্কুল, ১টি দাখিল মাদরাসা, ১টি নূরানী মাদরাসা ও এতিমখানা কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
রাজনৈতিক জীবনে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে। বিভিন্ন সময়ে ষড়যন্ত্রমূলক ও মিথ্যা মামলায় ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০৭, ২০১২ ও ২০১৪ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং প্রায় পাঁচ বছর কারাভোগ করেন। তবুও তিনি তার আদর্শ ও বিশ্বাস থেকে কখনো বিচ্যুত হননি।
একজন গবেষক, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়াও তিনি একজন prolifik লেখক। তাঁর প্রকাশিত ১৩টি গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান, প্লাবণ ভূমিতে মৎস্য চাষ: দাউদকান্দি মডেল, সংসদে কথা বলা যায়, ফখরুদ্দিন-মইন উদ্দিনের কারাগারে ৬১৬ দিন, রাজনীতির হালচাল, সময়ের ভাবনা, করোনাকালে বাংলাদেশ, আমার রাজনীতির রোজনামচা প্রভৃতি।
ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই পুত্র ও এক কন্যার জনক। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মমুখর জীবন দেশের রাজনীতি, শিক্ষা, গবেষণা ও সমাজসেবায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
আজ তাঁর ৮০তম জন্মদিনে দেশবাসী কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছে এই প্রথিতযশা মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিককে।
বিআলো/তুরাগ