মিরপুরে নর্দার্ন প্রোপার্টিজের দাপট: রাজউকের চোখের সামনে আদালতের আদেশ অমান্য
আদালতের আদেশ অমান্য করেই এগোচ্ছে মিরপুরের বহুতল প্রকল্প
ইবনে ফরহাদ তুরাগ: মহামান্য আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা মিরপুরে একটি বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ চলছে দ্রুতগতিতে। ইতোমধ্যে দুটি বেইজমেন্টসহ ভবনটির ১০ তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে। বহুমুখী ক্ষুদ্র কুটির শিল্প সমবায় সমিতির পক্ষে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান নর্দার্ন প্রোপার্টিজ লিমিটেড ভবনটি নির্মাণ করছে।
আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য
রাজউক সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহর নামে ভবনটির নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে ভবন নির্মাণের শুরু থেকেই নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এ কারণে রাজউক একাধিকবার মৌখিক ও লিখিত নোটিশ প্রদান করে।
পরে ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ হাইকোর্টে রিট (নং-১৪৬৯৪/২০২৩) দায়ের করেন। আদালত তা মঞ্জুর করলেও শর্ত ছিলো—রিট চলাকালে ভবনের সব ধরনের কাজ বন্ধ থাকবে। কিন্তু নর্দার্ন প্রোপার্টিজ সে নির্দেশ অমান্য করে নির্মাণ অব্যাহত রাখে। আদালতে রিট দায়েরকালে ভবনটির ৪ তলার কাজ শেষ হয়েছিল, বর্তমানে ১০ তলার ছাদ ঢালাই পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
নকশার চরম ব্যত্যয়
ভবন নির্মাণে একাধিক শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে। নকশায় চারপাশে খোলা জায়গা রাখার কথা থাকলেও তা মানেনি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটি। পেছনে ৪০ শতাংশ, দুই পাশে ১৫ শতাংশ এবং সামনের অংশে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ডেভিয়েশন করেছে তারা। এছাড়া পর্যাপ্ত ভয়েড না রাখা, সিঁড়ি ও লিফটের জায়গায় অসঙ্গতি, ফ্লোর এরিয়া রেশিওর শর্ত অমান্যসহ প্রায় সবখানেই নিয়ম ভাঙা হয়েছে।
রাজউকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা তো সামান্য কর্মকর্তা। নর্দানের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতনরাও ভয় পান। সাইটে গেলে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পর্যন্ত দেওয়া হয় না।”
দীর্ঘদিনের অনিয়মের ইতিহাস
শুধু মিরপুর নয়, প্রফেসর ইউসুফ আব্দুল্লাহর প্রতিষ্ঠান নর্দার্ন প্রোপার্টিজ ও প্রাসাদ নির্মাণ লিমিটেড গত ১৬ বছরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে প্রায় দুই শতাধিক ভবন নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে বহু ভবনই অনুমোদনহীন বা জাল নকশার মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর নয়া পল্টনের ৩/১১, কালভার্ট রোডে প্রাসাদ নির্মাণ কর্তৃক নির্মিত ১৭ তলা ভবনের নকশা মালিকানা জালিয়াতির অভিযোগে ২০০৯ সালে বাতিল হলেও পরে রিটের আড়ালে দীর্ঘদিন কাজ চালানো হয়। রাজউকের একাধিক নোটিশ ও প্রতিবেশীদের অভিযোগ উপেক্ষা করেই ভবনটি দাঁড়িয়ে যায়।
রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রভাবশালী সম্পর্ক
রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রফেসর ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিশেষ করে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকায় দীর্ঘদিন ধরে তিনি অনিয়ম করে আসলেও কেউ সাহস করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
প্রতারণার মামলা ও অর্থপাচারের অভিযোগ
২০১৩ সালে নর্দান ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের জন্য জমি ক্রয়ের ঘটনায় প্রতারণার অভিযোগে ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ গ্রেফতার হয়েছিলেন। এছাড়া নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ, মানি লন্ডারিং এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চলতি বছরের মে মাসে আদালত তার ও পরিবারের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
দোকান বিক্রিতে অনিয়ম
মিরপুরে নির্মাণাধীন এই বহুতল ভবনে প্রায় ৫০০ দোকানের পজিশন বিক্রি হয়েছে। প্রতিটি দোকান বিক্রি হয়েছে ন্যূনতম ৮০ লাখ থেকে কয়েক কোটি টাকায়। অভিযোগ রয়েছে, পুরোনো কমিটি কর্তৃক বিক্রিত দোকানগুলো নতুন কমিটি পুনরায় অন্যদের কাছে বিক্রি করছে।
প্রশ্নের মুখে রাজউক
রাজউকের সংশ্লিষ্ট জোনের অথরাইজড অফিসার বলেন, “বিষয়টি আদালতে রয়েছে। ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের করার তেমন কিছু নেই। তবে অনিয়ম প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এদিকে রাজউকের পরিচালক (জোন-৩) সালেহ আহমদ জাকারিয়ার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
প্রসঙ্গত, আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বহুতল ভবন নির্মাণ শুধু আইনকে অমান্য করাই নয়, রাজউকের অসহায়ত্ব ও প্রভাবশালীদের দাপটকেও স্পষ্ট করে তুলছে।
প্রশ্ন রয়ে যায়—রাজধানীর মেইন রোডে প্রকাশ্যে আদালতের নির্দেশ ভঙ্গ করে চলমান এই নির্মাণকাজ থামাতে আসলেই কি রাজউক অসহায়, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে নীরব?
বিআলো/নিউজ