মধ্যবত্তি সমাজ আজ কোন পথে ধাবিত ?
dailybangla
08th Aug 2025 7:36 pm | অনলাইন সংস্করণ
শতদল বড়ুয়া
বাঙালি মধ্যবিত্তরা কেমন আছেন ? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তোবা সহজে মিলবে না। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে মধ্যবিত্ত সমাজের কর্ম সাধনা, জ্ঞান ও ভাব সাধনার গৌরবে রচিত হয়েছে এই দেশের স্বর্ণালী ইতিহাস। সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতি সকল বিষয়ে জাতির সার্বিক মুক্তি আন্দোলনের কর্ণধার এ মধ্যবিত্ত সমাজ। ঊনিশ শতকীয় রেনেসাঁ তো এই সমাজেরই ভাবনা, চিন্তা ও বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ফল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় একদিন যারা গণজাগরণের জন্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যাদের অহোরাত্র শ্রমে সমগ্র জাতির পূর্ব আকাশে লাল সূর্যের সন্ধান পেয়েছিলো, জাতির ক্রান্তিলগ্নে অকূল সাগরে নৌকার মাঝির মতো শক্তহাতে বৈঠা নিয়ে কূলেরদিশা দেখিয়েছিলো তারাই আজ চরম অবক্ষয়ের পথে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। নিয়তির নির্মম পরিহাসে তারা আজ নানা সংকটের দ্বারপ্রান্তে, পেশীশক্তি তাদের ছাড়ছে না। কে তাদের এই সংকটকাল থেকে বাঁচাবে ? কে শুনাবে তাদের আশার বাণী ? কে তুলে দেবে তাদের হাতে নবজীবনের নিরাপদ ভবিষ্যতের চাবিকাঠি ।
মধ্যবিত্ত সমাজ ব্রিটিশ শাসনযন্ত্রের সৃষ্টি। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ব্রিটিশ শাসকরা মধ্যবিত্তদের নানা নিষ্পেষণে পেষিত করেছিলো। তারা চেয়েছিলো মধ্যবিত্তদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করতে। প্রথম প্রথম তারা এ কাজে সফলকামও হয়েছিলো। কিন্তু শক্তির অবাধ ক্ষমতা তাদের ভাগ্যে চিরস্থায়ী হলো না। তাদের মজ্জাগত চরিত্রের আসল রূপ মধ্যবিত্তের কাছে প্রকাশ পেলো। স্বদেশ ও সমাজেরা সাথে আবার নাড়ীর সম্পর্ক স্থাপিত হলো। কিন্তু দুইমেরুতে সৃষ্টি হয়ে রইলো অবিশ্বাস ও ঘৃণা। পরিবর্তনশীল সত্যবাক্যকে ইংরেজরা ঠেকাতে পারলো না। তাদের কৃতকর্মের কারণে তারা এ দেশ থেকে বিদায় গ্রহণ করতে বাধ্য হলো। আশা ছিলো জাতীয় সরকারের অনুগ্রহে মধ্যবিত্ত সমাজ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে এবং সগৌরবে মাথা উঁচু করে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। তা আর হলো না, নিদারুণ রহস্যের বেড়াজালে আটকে হাহাকারে সে আজ বড়ই অসহায়, ক্লান্ত এবং অবসন্ন।
আমাদের এ দেশে নতুনতর সমাজ বিন্যাস শুরু হয়েছিলো প্রথম মহাযুদ্ধের ক্রান্তিকাল থেকে। এ যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে শিল্প-বাণিজ্যের নানা সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হতে শুরু করলো। যার কারণে শিল্প-বাণিজ্যের মাধ্যমে কেউ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, কেউ হয়েছে দরিদ্র। মধ্যবিত্ত সমাজের কোনো গতি হলো না। যেই তিমিরে ছিলো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। হায় সমাজ ! আজ একদিকে খেটে খাওয়া মেহতি মানুষ, অন্যদিকে তার শোষণে পিষ্ঠ বিলাসী ধনিকশ্রেণী। এই দুইয়ের মধ্যখানে আর কোনো স্থান অবশিষ্ট থাকলো না মধ্যবিত্ত সমাজের জন্যে।
আমার লেখার শুরুতেই প্রশ্ন রেখেছিলাম। আবারো লিখছি মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্থান কোথায় ? এরা বিলাসী পয়সাওয়ালা শ্রেণির নয়, এরা শ্রমজীবীদের পর্যায়েও পড়ে না। এরা আত্মশ্রমে “নিজেকে নিজে” বিকশিত করে থাকে। সমাজের সেই রং প্রথম মহাযুদ্ধের সময় থেকে বদলানোর সারিতে সামিল হয়েছিলো। জমিদারী প্রথা উচ্ছদের পর তা আরো বিকট রূপ ধারণ করতে ক্রিয়াশীল। এই উত্থানের ফলে মধ্যবিত্ত সমাজে দেখা দিলো এক চরম বিপর্যয়।
শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, আইনজীবী আজ সমাজের অবহেলার পাত্র। অথচ একদিন এ ধরনের লোকদের হাতেই ছিলো সমাজের লাটাই-সূতা। তারাই সমাজ পরিবর্তনের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো। বর্তমানে সেই লাটাই সূতার হাতবদল হয়ে গেছে যুগ পরিবর্তনের কারণে। তাই তারা আজ যুগ প্রণেতার প্রতিক্রিয়ায় ধনিক সমাজের সমর্থক হতে পারে না। শিক্ষাদীক্ষা ও সহানুভূতি শ্রমিক সমাজের দিকে আকৃষ্ট করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তারাই নেতৃত্বহীন শ্রমিক সমাজের সামনের কাতারে এসে সামিল হবে এবং বীরদর্পে আত্মত্যাগের মাধ্যমে বন্ধনমুক্তির দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়ে নবজাগরণের মাইলফলক স্থাপন করবে।
দেশে কৃষি সভ্যতার মেরুদণ্ড সেই অনেক আগে থেকেই ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিলো। কলকারখানার বিকাশ ও প্রসারে উদ্ভব হলো শ্রমিক শ্রেণির। অতি স্ফীত হয়ে উঠলো ধনিক শ্রেণী। বাজার দর লাগামহীন ঘোড়ার মতো দৌঁড়াতে শুরু করলো। এই চড়া বাজারের পাল্লায় টিকে থাকতে পারলো না মধ্যবিত্তরা। তারা হয়ে পড়লো মুমূর্ষু। এভাবে কিছুদিন কাটলো মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার আঘাত হানলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশ বিভাগ মধ্যবিত্তের মেরুদণ্ড দ্বিতীয় দফায় ভেঙে দেওয়া হলো।
সকলের সাথে শেয়ার করে রাতদিন অতন্দ্র প্রহরীর মতো সজাগ থেকে মধ্যবিত্তরা যে স্বাধীনতা বাঙালির জীবনে এনেছিলো অজেয় স্রোতধারার মতো আনন্দে। সেই স্বাধীনতাই মধ্যবিত্তদের আশাহত করলো বেশী। মধ্যবিত্তের যে যন্ত্রণা তা হলো অর্থনৈতিক। এই অর্থনৈতিক সংকট কেটে উঠার জন্যে আজ পর্যন্ত কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা কেউ নিতে পারেনি। অবিলম্বে সুষ্ঠু পরিকল্পনা রচিত হওয়া অপরিহার্য। মধ্যবিত্তের যন্ত্রণার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে আগে এগিয়ে আসতে হবে সচেতন নাগরিকদের। কারণ এই নব্য সমাজে মধ্যবিত্ত সমাজ তার সীমিত ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে তার নিজস্থান খুঁজে পাচ্ছে না।
বিচার বিশ্লেষণে মধ্যবিত্ত সমাজ কিন্তু সহজে পার পেতে পারে না অর্থনৈতিক দিকদিয়ে। এর জন্যে পরোক্ষভাবে তারাই দায়ী। ভুল বা অসংগতিপূর্ণ কাজে অর্থ ব্যয়, অমিতব্যয়িতার ফাঁদে জড়িয়ে আমোদ প্রমোদে মত্ত থাকাটাই মধ্যবিত্তদের জন্যে অশনি সংকেত হিসেবে দেখা দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে সহসা তারা ঋণভারে জর্জরিত হচ্ছে। যুগ বদলে গেছে, জীবন সংগ্রামের পথও অন্যরূপ ধারণ করেছে। এ সমস্ত নানাবিধ কারণ জ্ঞাত না হওয়াতে নিজেরাই নিজেদের জালে আটকে যাচ্ছে ক্রমাগত।
তাই আজ শ্রমের মর্যাদাবোধ ও অহেতুক সামাজিকতা বর্জন এবং সমবায়িক প্রয়াস, সরকারি দাক্ষিণ্য, নারী প্রগতি ও আজীবন বীমা প্রকল্পের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত সমাজের পুনরুজ্জীবন সম্ভব। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সম্ভবত মধ্যবিত্ত কোনো শ্রেণী নেই, এমন কি সারাবিশ্বে আজ পর্যন্ত মধ্যবিত্ত সমাজ লুপ্ত বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার মতো একটা ব্যাপার হলো মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের শিক্ষিত যুবকরা নানা কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে দ্বিধাবোধ করছে না। হকার, বাসচালক, কন্ডাকটর এবং কারখানার শ্রমসাধ্য কাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির যুবকরা নবউদ্যোমে কাজ করছে দেখা যায়।
দেশের শিল্প ও সংস্কৃতির পথিকৃৎ মধ্যবিত্ত সমাজ আজ সসম্মানে বাঁচার সংগ্রামে অবতীর্ণ হচ্ছে। এতে করেও মনের ভীতি কাটছে না। যে জীবন সংগ্রাম যন্ত্রণার অবসানের লক্ষ্যে নিবেদিত তা শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে উঠে জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে পারবে তো মধ্যবিত্ত সমাজের লোকেরা ?
লেখক : শতদল বড়ুয়া
সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং প্রাবন্ধিক
বিআলো/ইমরান