মাছে-ভাতে বাঙালি: ঐতিহ্যের গর্ব থেকে সংকটের বাস্তবতা
মোঃ ফরহাদ হোসেন বাবু: বাংলার মানুষের গর্বের প্রতীক ছিল “মাছে-ভাতে বাঙালি”। মাছ কেবল খাদ্য নয়, এ দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিয়ে, উৎসব, সামাজিক অনুষ্ঠান-সব আয়োজনেই মাছ থাকত রসনার শীর্ষে। গ্রাম থেকে শহর, ধনী থেকে সাধারণ-প্রত্যেকের জীবনযাত্রায় মাছের প্রভাব ছিল গভীর। কিন্তু সেই ঐতিহ্য আজ ক্রমেই সংকটের মুখে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে মৎস্য খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৯১ হাজার মেট্রিক টন মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে অর্জিত হয়েছে ৫১৪৫ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা। জাতীয় জিডিপির প্রায় ৩.২৫ শতাংশ আসে এই খাত থেকে।
দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। এই খাত শুধু জনগণের পুষ্টি চাহিদা মেটায় না, দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানেও বড় ভূমিকা রাখে।
দুঃখজনক হলো, প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে মাছকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ন ও জলাশয় ভরাটে মাছের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। শিল্পকারখানার বর্জ্য, নৌযানের তেল-ধোঁয়া ও কৃষিজমিতে কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার পানির গুণগত মান নষ্ট করছে। এর ফলে দেশি প্রজাতির মাছ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এবং অনেক মাছ বিলুপ্তির পথে যাচ্ছে।
মৎস্য সম্পদের অবক্ষয়ের আরেকটি বড় কারণ হলো অসচেতন মাছ আহরণ। প্রজনন মৌসুমে মা মাছ ধরা, অপ্রয়োজনীয় ছোট মাছ নিধন এবং বেহুন্দি জালের মতো অবৈধ জাল ব্যবহার প্রতিনিয়ত মাছের বংশবিস্তার ব্যাহত করছে। সামান্য কিছু বড় মাছ ধরে লক্ষ লক্ষ পোনা ধ্বংস করা হচ্ছে। অবৈধ প্রযুক্তি ও রাসায়নিক প্রয়োগ মাছ ধরা হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি।
প্রতিবছর জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উদযাপন করা হলেও বাস্তবে তেমন পরিবর্তন চোখে পড়ে না। নানা প্রকল্প, পোনা অবমুক্তকরণ ও ভর্তুকির নামে বরাদ্দ দেওয়া হলেও এর বড় অংশ ব্যয় হয় না সঠিক খাতে। মৎস্য কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের কারণে মাঠপর্যায়ে উদ্যোগগুলো কার্যকর হয় না। নিষেধাজ্ঞার সময় অনেক জেলে টাকার বিনিময়ে মাছ ধরার সুযোগ পায়, যা প্রশাসনিক যোগসাজশের ফল।
২০০৫-০৬ অর্থবছরে মৎস্য রপ্তানি আয় ছিল ৩৫০০ কোটি টাকা। ২০১০-১১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭৯০ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৫১৪৫ কোটি টাকায়। কাগজে-কলমে আয় বেড়েছে, তবে প্রশ্ন থেকে যায়-উৎপাদন কি সত্যিই বেড়েছে?সাধারণ মানুষের মাছ কেনার সামর্থ্য কি বাড়ছে? জাতীয় মাছ ইলিশ কি মানুষের নাগালে আছে? বাস্তবতা হলো, উৎপাদন ও প্রাপ্যতা কমেছে, দাম বেড়েছে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
২০১২ সাল থেকে প্রায় ১৮ লাখ জেলে নিবন্ধিত হয়েছে। তাদের বছরে দুই কিস্তিতে ১৭২ কেজি চাল দেওয়ার ঘোষণা থাকলেও অধিকাংশই তা পান না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরিশাল বিভাগের ২ লাখ ৩০ হাজার জেলের মধ্যে প্রায় ২ লাখ জেলে সরকারি চাল থেকে বঞ্চিত হন।
এছাড়া মৎস্য খাতের নানা প্রকল্প ও মেগা প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও এর বাস্তবায়ন খুবই নগণ্য।
বাংলাদেশের মৎস্য খাত এখন এক গভীর সংকটে। নিয়ন্ত্রণহীন আহরণ, প্রশাসনিক দুর্নীতি, অযোগ্যতা এবং অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা এ খাতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবিকা ও পুষ্টির সঙ্গে জড়িত এ খাতের উন্নয়নে এখনই দরকার-দুর্নীতি দমন, স্বচ্ছ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, জেলেদের সচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোরভাবে সরকারি নিয়ম বাস্তবায়ন অন্যথায় “মাছে-ভাতে বাঙালি” প্রবাদটি শুধু ইতিহাসের পাতায় রয়ে যাবে, বাস্তবে নয়।
বিআলো/এফএইচএস