মোটা অংকের ক্ষতিপূরণের মুখোমুখি বাপেক্স
৫২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের মুখে পড়েছে বাপেক্স
ক্ষতিপূরণের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে
নিউজ ডেস্ক: তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স মোটা অংকের ক্ষতিপূরণের মুখোমুখি হয়েছে। গ্যাসকূপ খনন প্রকল্প নিয়ে বিদেশি কোম্পানির করা মামলায় প্রাথমিকভাবে ৫২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের মুখে পড়েছে বাপেক্স। বিগত ২০১৭ সালে আজারবাইজানের কোম্পানি সকারের সঙ্গে তিনটি গ্যাসকূপ খনন করতে বাপেক্স ৩৯৯ কোটি টাকার চুক্তি করেছিল। এখন ওই বিদেশি কোম্পানিটি আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তি আদালতে ওই চুক্তি ভঙ্গসহ কয়েকটি অভিযোগে বাপেক্সের বিরুদ্ধে মামলা করে আংশিক রায় পেয়েছে। যদিও ওই রায়ের বিরুদ্ধে এখন আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাপেক্স। আইনজ্ঞদের মতে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা করতে না পারা এবং আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা পরিচালনায় উপযুক্ত আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতে না পারায় বাপেক্স এ ক্ষতির মুখে পড়েছে। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে মামলার বাকি রায় এলে। জ্বালানি বিভাগ ও বাপেক্স সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
আজারবাইজানের কোম্পানি সকার বিগত ২০২০ সালে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে (এসআইএসি) এ মামলা করে। গত ৪ জুলাই আদালত আংশিক রায় দেয়। বাপেক্স মামলায় চূড়ান্তভাবে হেরে গেলে সকারকে প্রকল্পের মোট খরচের চেয়ে বেশি অর্থ দিতে হবে। কোম্পানিটি আংশিক কাজ করেই পাবে। সকারের খনন করা কূপে যদিও গ্যাস পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রশ্ন ছিল খনন কাজে কোম্পানিটির সক্ষমতা নিয়েও। বিদেশি কোম্পানিটি বাংলাদেশের স্থলভাগের খাগড়াছড়ির দক্ষিণ সেমুতাং-১, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ-৪ ও জামালপুরের মাদারগঞ্জ-১ তিনটি কূপ খননে চুক্তি করেছিল। তার মধ্যে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সেমুতাং-১ কূপটি খনন করে কোনো গ্যাস পাওয়া যায়নি। যদিও খনন বাবদ বাপেক্স সকারকে ১৪২ কোটি টাকা পরিশোধ করে। কিন্তু সকারের সঙ্গে বাপেক্সের জটিলতা দেখা দেয় অন্য দুটি কূপ খননের প্রস্তুতি খরচ এবং খননস্থান নির্ধারণ নিয়ে। বাপেক্সের মতে, বেগমগঞ্জ-৪ কূপ খননের আগে প্রস্তুতির জন্য চুক্তির বাইরে গিয়ে সকার ৭৩ কোটি টাকা অগ্রিম দাবি করে। বাপেক্স ওই আগাম অর্থ দিতে রাজি হয়নি। আর সেমুতাং-১ কূপ খনন বাবদ বিল পরিশোধে বাপেক্স দেরি করেছে এমন দাবি করে সকার ২০১৯ সালের জুনে চুক্তি বাতিলের কথা জানিয়ে দেয়। তাদের দাবি, কাজ শেষ হওয়ার ২৮ কর্মদিবসের মধ্যে বাপেক্স বিল পরিশোধ করেনি।
আজারবাইজানের প্রতিষ্ঠানটি পারফরম্যান্স গ্যারান্টি, রিগ আটকে রাখা, ডিমোবিলাইজেশন, আনুষঙ্গিক ক্ষতি এবং সাব-কন্ট্রাক্টরের পাওনাসহ ১১ বিষয়ে প্রায় ৮৮৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করে। ওই মামলায় বাপেক্স ২০২১ সালে নিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইনি প্রতিষ্ঠান ফলিহগকে। গত ৪ জুলাই এসআইএসি সকারের দুটি দাবি পুরোপুরি বহাল, পাঁচটি আংশিক এবং চারটি দাবি খারিজ করে দিয়ে বাপেক্সকে ৫২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয়। তবে আদালত সকারের ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতি সংক্রান্ত অভিযোগে ১১৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা এবং প্লাগ অ্যান্ড অ্যাব্যান্ডনমেন্ট বাবদ ৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি খারিজ করে দেয়। একইভাবে অযৌক্তিক বলে রায়ে উল্লেখ করা হয় ডিমোবিলাইজেশন সংক্রান্ত ১৭ কোটি ১৪ লাখ টাকার দাবি। প্রকল্পের রাস্তা তৈরির বিলম্বজনিত ক্ষতিপূরণ বাবদ দাবি করা ১৯ কোটি টাকার মধ্যে সকারকে ৪ কোটি টাকা দিতে বলা হয়। আর আরেকটি কূপ খনন-সংক্রান্ত খরচ হিসেবে দাবি করা ৫২ কোটি ৪০ লাখ টাকার মধ্যে ৩৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা দিতে বাপেক্সকে নির্দেশ দেন আদালত।
আদালতে রিগ আটকে রাখার জন্য বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছিল। ওই দাবির প্রায় ৩৩ শতাংশ কমিয়ে আদালত সকারের পক্ষে ১৯৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ মঞ্জুর করে। একইভাবে দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় রিগের ক্ষতির জন্য দাবি করা ক্ষতিপূরণের ৪০ শতাংশ কেটে আদালত ১১৪ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে। রিগের জন্য ওই ৩০৯ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ শোধ না করলে প্রতিদিন ৯০ লাখ টাকা জরিমানা বাড়তে থাকবে। তাছাড়া পারফরম্যান্স গ্যারান্টি বাবদ দাবি করা ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং সাব-কন্ট্রাক্টর বেকার হিউজেস-এর দাবিকৃত প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা পুরোপুরি বাপেক্সকে দিতে হবে। তবে সাব-কন্ট্রাক্টর পার্কার-এর দাবির ৪০ শতাংশ কেটে ৪ কোটি ৫৩ টাকা অনুমোদন করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে সমঝোতার ভিত্তিতে আরো সমন্বয় হতে পারে। আর পরিণামমূলক ক্ষতিপূরণের দাবি আংশিকভাবে মঞ্জুর হলেও সঠিক অর্থের পরিমাণ রায়ে উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে বাপেক্স সংশ্লিষ্টদের মতে, চুক্তির দ্বিগুণ সময় নিয়ে সকার প্রথম কূপ খনন করে। তাতে বিল পরিশোধে কিছুটা দেরি হয়। যা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হলেও সরকার সরাসরি চুক্তি বাতিল করে। তারপরও বাপেক্সকাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করে। কিন্তু সরকার তা শোনেনি। বরং খননকাজ অসমাপ্ত রেখেই বাংলাদেশ ছেড়ে যায়। ওই সময় সরকার অন্তত ৬টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পাওনা টাকা পরিশোধ করেনি। ওই দেনা-পাওনা পরিশোধ করতে আজারবাইজানও বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করে। কিন্তু সমঝোতায় বসেনি সকার। আর পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন না করার কারণেই মামলায় বাপেক্সকে হারতে হয়েছে। এসআইএসি যদি পূর্ণাঙ্গ রায় আগের সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রাখে তাহলে বাপেক্সকে মামলা সংক্রান্ত সব খরচও দিতে হবে। এখন বাপেক্স নতুন আইনজীবীদের পরামর্শে ফ্রান্সের কোর্ট অব প্যারিসে আপিল করতে পারে। মামলা চালাতে প্রতিষ্ঠানটির গত বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার একজন পরিচালক বলেন, মামলার কাগজপত্র বিশেষণ করে দেখা গেছে, বাপেক্সের আত্মপক্ষ সমর্থনের অনেক যুক্তি ছিল। কিন্তু সেগুলো সেভাবে তুলে ধরা হয়নি। এখন জোরালোভাবে আপিলের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
বিআলো/ইমরান