রাজধানীর ৪ নদী দখল-দূষণে বিপন্ন, ৬৩১ উৎসমুখ
কমে গেছে নদী অক্সিজেনের পরিমাণ
চারটি নদীর দূষণে দায়ী ঢাকা ওয়াসা
যথাযথভাবে জলবায়ু দায়িত্ব পালনের আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার
রতন বালো: রাজধানীর চারপাশে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীগুলো দখল-দূষণে বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ৬৩১টি উৎস থেকে দূষিত হচ্ছে। এর মধ্যে ২৫৮টি উৎস দিয়ে বুড়িগঙ্গায় সরাসরি বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এছাড়াও, তুরাগ ও বালু নদীতেও বিভিন্ন দূষিত পদার্থ ফেলা হচ্ছে।
এছাড়া ২৫৮টি পয়েন্ট দিয়ে গৃহস্থালি, শিল্পবর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। এছাড়া তুরাগ নদীতে ২৬৯টি ও বালু নদীতে ১০৪ পয়েন্ট দিয়ে কঠিন বর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য পড়ছে। এর মধ্যে টঙ্গীর কামাড়পাড়ার প্রত্যাশা ব্রিজ থেকে পাগাড় পর্যন্ত প্রায় ২২টি ডাইং ও ওয়াশিং কোম্পানির কারখানা থেকে দূষিত রঙিন পানি সরাসরি পড়ছে তুরাগ নদীতে।
এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পয়েন্টগুলো সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার তৈরি। নদী তীরে গড়ে ওঠা অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যে দূষিত ঢাকার নদীগুলো। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদী দূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২৮৩ কোটি ডলার। এ পরিস্থিতি নিরসনে কোন উদ্যোগ না নেওয়া হলে, নদী দূষণের কারণে মোট আর্থিক ক্ষতির অঙ্ক আগামী ২০ বছরে ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে।
নদীগুলোর ৬০ শতাংশ দূষণই হয় শিল্প বর্জ্যরে কারণে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নিষ্কাশন নালার মাধ্যমেই ১৫ শতাংশ দূষণ হয়। ১০ শতাংশ ঘটছে জাহাজ, লঞ্চ ও অন্য নৌযানের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি এবং মলমূত্র নদীর পানিতে মেশার ফলে। প্রকৃতপক্ষে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী এবং টঙ্গী খালে প্রায় ৬০ হাজার ঘনমিটার বিষাক্ত বর্জ্য প্রধানত ৯টি শিল্পঘন এলাকা- টঙ্গি, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, তারাবো, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, ডিইপিজেড ও ঘোড়াশাল থেকে আসে।
কমে গেছে নদী অক্সিজেনের পরিমাণ :
বর্তমানে বুড়িগঙ্গার সদরঘাট এলাকায় দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্য দশমিক ২৪ মিলিগ্রাম। বিষাক্ত পানির কারণে মাছ ও পোকামাকড়সহ কোন প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারছে না। দূষিত হওয়ার কারণে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০টি নদীর মধ্যে বুড়িগঙ্গা একটি। এই নদীর পানিতে ক্ষতিকর পদার্থ ক্রোমিয়াম, আয়রন ও জিংকের মতো ভারি ধাতু রয়েছে বলে বিশ্বব্যাংকের উদ্ধৃতি দিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)’র বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণরোধে একটি এক কর্ম পরিকল্পনার প্রতিবেদনে এই তথ্য উল্লেখ করা হয়।
বিআইডব্লিউটিএ’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ ও ধলেশ্বরী নদী প্রতিদিন মারাত্মক দূষিত হচ্ছে। এই দূষণের ফলে নদীর পানি তার স্বাভাবিক রঙ হারিয়ে ফেলেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০০৭ অনুযায়ী মৎস্য ও জলজ প্রাণীর জন্য প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন ৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি।
এছাড়া ঢাকার চারপাশের নদী দূষণের উৎসমুখগুলো চিহ্নিত করে তা বন্ধ ও নদীর নাব্যতা রক্ষায় সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের সভাপতিত্বে ২০০৯ সালে গঠন করা হয় টাস্কফোর্স। এই কমিটি অর্ধশত বৈঠক করে একাধিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও ঢাকার চারদিকে এই বর্জ্যরে উৎসমুখ বন্ধ করা যায়নি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানায়।
যথাযথভাবে জলবায়ু দায়িত্ব পালনের আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার:
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আজ বৈশ্বিক অংশীজনদের প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান গ্রহণে এবং উন্নত দেশগুলোকে যথাযথভাবে তাদের জলবায়ু দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। গত ২৩ জুলাই ‘জলবায়ু পরিবর্তনে সম্প্রদায় ও বাস্তুতন্ত্রের সহনশীলতা বৃদ্ধি’ প্রতিপাদ্যে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত মেঘনা নলেজ ফোরাম ও ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, বিশ্বের উন্নয়ন ভাবনাকে অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। এটি কম প্রতিকূল, কম সম্পদ-কেন্দ্রিক এবং আরো বেশি প্রকৃতি-কেন্দ্রিক হতে হবে।
বাংলাদেশের নদী এবং জাতীয় পরিচয়ের গভীর সম্পর্ক তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে নদীর দেশ বললে ভুল হবে না। নদী ও নদীর পরিবেশ আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভারত ও চীনের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনায় আরো জোরালো আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। উপদেষ্টা জানান, বাংলাদেশের চারটি প্রধান নদী অববাহিকা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভাগাভাগি করার ফলে সহযোগিতামূলক পরিবেশ শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
তার বক্তব্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ‘নদীর অধিকার’ সংক্রান্ত আলোচনা। তিনি বলেন, আমাদের নদীগুলোকে শুধু নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নয় বরং তাদের নিজস্ব অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েও রক্ষা করা উচিত। তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিচারব্যবস্থা ইতোমধ্যে নদীর অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতেও এ বিষয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ৭০০টির বেশি নদী ছিল, এর অনেকগুলোই আজ মৃত। যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, বুড়িগঙ্গার মতো প্রধান নদীগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। শুকনো মৌসুমে প্রায় ৩০ শতাংশ নদী পানিশূন্য হয়ে যায়। নদীর তীর দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, চাষাবাদ এবং ব্যবসার জন্য নদীর জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। কলকারখানার বর্জ্য, নগরীর গৃহস্থালির ময়লা এবং প্লাস্টিকের আবর্জনা নদীতে ফেলা হচ্ছে। বিশেষ করে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলীর পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নদী রক্ষায় নদীর সীমানা নির্ধারণ করে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। জনগণকে বোঝাতে হবে যে নদী দখল আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি করছে। কলকারখানার তরল বর্জ্য পরিশোধনাগারের (ইটিপি) মাধ্যমে নিঃসরণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্লাস্টিকদূষণ কমাতে পলিথিন নিষিদ্ধ করা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
বিআলো/তুরাগ