হজরত সাইয়্যিদ আহমদ আলী সুরেশ্বরী (র.)’র জীবন ও কর্ম
সুরেশ্বর দরবার শরীফ বাংলাদেশের একটি সুপ্রসিদ্ধ তাসাউফ শিক্ষাকেন্দ্র। এ দরবারটি বাংলাদেশের শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার সুরেশ্বর গ্রামে অবস্থিত। পদ্মা নদীর ভাঙনে শতশত বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেলেও পদ্মার পাড় বেয়ে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সুরেশ্বর দরবার শরীফ। এ অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে সমাহিত আছেন আধ্যাত্ম জগতের অবিস্মরণীয় ও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব শামসুল ওলামা শাহ সুফি সাইয়্যিদ আহমদ আলী সুরেশ্বরী (র.)। এ মহান মাদারজাত অলি-১৭ নভেম্বর, সোমবার, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ, সুবহে সাদিকের সময় সৈয়দ মাওলানা মেহের উল্লাহ (র.)’র ঔরসে এবং সৈয়দা নূরজাহান (র.)’র মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভক্ত-মুরিদানের কাছে সুরেশ্বরী, জানশরীফ এবং জানু বাবা নামে পরিচিত। তার শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন এবং সাধনাজীবন ছিল খুবই চমকপ্রদ। তার শিক্ষাজীবনের প্রারম্ভিকতা শুরু হয়, গ্রামীণ মক্তব ও মাদরাসায়। বঙ্গদেশে পড়াশুনা শেষ করে উচ্চতর শিক্ষার্জনের নিমিত্তে বিদ্যোৎসাহী পিতার প্রচেষ্টায় ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ‘কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে সুনামের সঙ্গে পড়াশুনা শেষ করে উক্ত প্রতিষ্ঠানে প্রথমে শিক্ষক (মুদাররিস) হিসেবে যোগদান করলেও পরবর্তীতে কর্মদক্ষতার ফলে ‘হেড মাওলানা’ পদে অভিষিক্ত করেন। ১৮৯১-১৯১২ সাল পর্যন্ত উক্ত মাদরাসার হেড মাওলানার দায়িত্ব পালন করেন। জ্ঞানীদের কাছে তিনি ‘শামসুল ওলামা’ নামে পরিচিত। সমকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ আলেম-ওলামাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বজন গৃহীত ও সমাদৃত ব্যক্তিত্ব। কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় অধ্যয়নকালে হজরত সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসি (র.)-এর সান্নিধ্যে এসে তাসাউফ চর্চা শুরু করেন। বারো বছর কঠোর রিয়াজত ও মেহনত করে তরিক্বতের সমস্ত ছবক ও দায়রা শেষ করে চূড়ান্তভাবে ইলমে বেলায়াত লাভ করেন এবং তরিক্বতের খেলাফত অর্জন করেন। ১৮৮৬ সালে সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসি (র.)’র ইন্তোলের পর পীর-নন্দিনী হজরত সৈয়দা জোহরা খাতুন (র.) থেকে নিসবতে জামিয়ার ফয়েয হাসিল করে পীরে মুকাম্মেল পদে সমাসীন হন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইলমে শরিয়ত ও ইলমে মারিফত জ্ঞান অর্জন করায় তার চিন্তা-চেতনা, জীবন দর্শন এবং আধ্যাত্মিক কর্মপদ্ধতি ছিলো খুবই বৈচিত্র্যময়। তার জীবন ও সাধনার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল, খোদাপ্রেম ও নবীপ্রেম। তিনি সবসময় আল্লাহর প্রেমে মজে থাকতেন এবং নবী করিম হজরত মুহাম্মদ (দ.)’র জিকিরে জবান ও ক্বলবকে অবিশ্রান্ত রাখতেন। তিনি তার অনুরসারীদের দ্বীনধর্মের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়সমূহ শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি আল্লাহ তা’আলা ও তার প্রিয় হাবিব হজরত মুহাম্মাদুর রাসূল (দ.)’র ইশ্ক, মুহাব্বত ও কুরবত হাসিলের প্রতি উৎসাহিত করতেন। তিনি, প্রায়শ মাক্বামে ফানাফিশ শায়খ, ফানাফির রাসূল (দ.), ফানাফিল্লাহতে অবস্থান করতেন এবং মুরাক্বাবা এবং মুশাহেদায় মশগুল থাকতেন। জগৎ বিখ্যাত আলেম হওয়া সত্ত্বেও সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসি (র.)’র আনুগত্যের প্রতি সদা শ্রদ্ধাশীল থাকতেন এবং তাবেদারি করতেন এবং ‘দিওয়ানে ওয়াইসি’ এর কবিতা সমগ্র আবৃত্তি করে রাসূল (দ.)’র প্রেমে সদা অশ্রু বিসর্জন দিতেন এবং নিজের লেখা স্বরচিত হামদে বারি তা’আলা এবং নাতে মুস্তফা (দ.) ছন্দে ছন্দে আবৃত্তি করে নিজের মধ্যে খোদাপ্রেম ও নবীপ্রেমের জাগরণ সৃষ্টি করতেন। তার লিখিত সাহিত্য ও কবিতাগুলোকে তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করলে মনে হয় তিনি ছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতে, ছন্দের যাদুকর। সৈয়দ আহমদ আলী সুরেশ্বরী (র.) ছিলেন ‘ক্বলবে সালিম’ এর অধিকারী। ক্বলবে সালিম বলতে বুঝায়, শিরক ও বিদ’আতমুক্ত পবিত্র আত্মা। ক্বলবে সালিমের অধিকারী ব্যক্তিগণের অন্তরে আল্লাহর মহব্বত ও ভয় ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। সুরেশ্বরী (র.)’র মাধ্যমে বাংলা-ভারতের বহু জায়গায় সুফি-ধারা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শরিয়ত, তরিক্বত, মারিফত ও হাকিক্বতের সমন্বয়ে প্রতিটি অনুসারীকে ইসলাম শিক্ষা দিতেন। শিরক ও বিদয়া’তসহ ধর্মীয় নানান কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। সমকালীন সময়ে ফরায়েজী আন্দোলনের কার্যকর প্রভাব ছিল, ফরিদপুর অঞ্চলে বেশি। এ কারণে বেজুম্মা দলের কার্যনীতি এ অঞ্চলে বেশি কার্যকর সাধিত হয়। সুরেশ্বরী (র.) বেজুম্মা দলের ফতোয়া খণ্ডন করে ফরিদপুর অঞ্চলসহ বঙ্গদেশের বহু জায়গায় পুনরায় জুমার নামাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সুরেশ্বরী (র.) একাধারে ছিলেন, যুগশ্রেষ্ঠ আলেমেদ্বীন, মুফাচ্ছিরে কুরআন, শায়খুল হাদীস, ফকীহুল আরব ওয়াল আজম এবং প্রখ্যাত আধ্যাত্মবিদ। এ মহান আলেমেদ্বীন! কখনো ইলমের বাহাদুরী করতেন না। কারো মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলতেন না। অথচ একটি কুচক্রী মহল সুরেশ্বর কে (র.) হায়াতে জিন্দেগীতে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অপবাদ, অপমান এমনকি প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি খুবই দয়ালু ও ক্ষমাশীল ছিলেন। কারণ আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোর মাঝে একটি হচ্ছে, ক্ষমাশীল। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা আল্লাহর সমস্ত গুণবাচক নাম নিজেদের বাস্তব জীবনে প্রতিফলন ঘটিয়ে আল্লাহর বন্ধুতে পরিণত হয়। সুরেশ্বরী (র.) ছেমা মাহফিল খুবই পছন্দ করতেন। তবে তিনি ছিলেন পুরোপুরি শরিয়তপন্থি। শরিয়তের বাইরে কোনো কাজ করতেন না। বর্তমান সময়ের নানান অপসংস্কৃতির জন্য তিনি দায়ী নন।তার দৈনন্দিন কাজের মধ্যে ছিলো- কুরআন পাঠ, হাদিস ও তফসির পাঠ, ফিকাহ ও ফরায়েজ সংক্রান্ত মাসাআলার সমাধান, জামায়াত সহকারে নামাজ আদায় করা, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ আদায়, তরিক্বতের ওজিফা আদায়, মুরাক্বাবা-মুশাহেদা সাধন এবং মুুরিদের যোগ্যতা অনুসারে ছবক, ফায়েয ও তাওয়াজ্জুহ প্রদান। বাংলার পরতে পরতে সুরেশ্বরী (র.)’র মাধ্যমে বহু কামেল অলি-আল্লার জন্ম হয়েছে। তৎকালীন সময়ে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষাবিদ তথা কলকতা আলীয়া মাদরাসার হেড মাওলানা। এক দিকে যেমনি শরিয়তের বিজ্ঞ আলেম ছিলেন; অন্যদিকে ছিলেন ইলমে মারিফাতের বিদগ্ধ আলেম। সুরেশ্বরী (র.)’র রচিত গ্রন্থের মধ্যে- (১) নূরে হক্ব গঞ্জে নূর, (২) ছাফিনায়ে ছফর, (৩) কাওলুল কেরাম, (৪) মদিনা কলকি অবতারের ছফিনা, (৫) সিররে হক্ব জামে নূর, (৬) লত্বায়েফে শাফিয়া, (৭) আইনাইন, (৮) মাতলাউ’ল উলুম প্রভৃতি উল্লেখ্যযোগ্য। সুরেশ্বরী হজরত! আমৃত্যকাল পর্যন্ত ইসলামী শিষ্টাচারপূর্ণ জীবনযাপন করে শতশত মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে ধাবিত করেছেন। তিনি আমৃত্যকাল কুরআন ও হাদিসের সঠিক রূপরেখা অনুযায়ী জীবনযাপন করেছেন; এজন্য তাকে সুন্নাতে নববীর প্রতিচ্ছবি বলা হয়। উপাধিসমূহ-চৌদ্দশতকের মুজাদ্দেদ, গাউছে আলম, পীরে মুকাম্মেল, কুতুবুল এরশাদ। সুরেশ্বরী (র.)-১৭ নভেম্বর, সোমবার, ১৯১৯ সালের সন্ধ্যা ৫.৩০ মিনিটে ৬৩ বছর বয়সে নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে বেছালে হক্ব লাভ করেন। সুরেশ্বরী হজরত ক্বেবলার দর্শন ও সাধনার মূল শিক্ষা ব্যবস্থা; কালের আবর্তনে এবং যুগের পরিবর্তনে বিকৃতভাবে সংযোজিত ও বিয়োজিত হয়ে হয়েছে; এজন্য বিভিন্ন মহল সুরেশ্বরী (র.)’র সমালোচনা করে থাকে। বিদায় হজে নবীয়ে পাক হজরত মুহাম্মদ (দ.) বলেছেন, ব্যক্তির জন্য পুরা গোত্র দোষী নয়। অনুরূপে বলা যায়, ভক্ত বা মুরিদের গর্হিত কাজের জন্য সুরেশ্বরীকে (র.) দোষী সাব্যস্ত করা অনুচিত। যুগে যুগে কুচক্রী মহলের হাতে ইতিহাস বিকৃত হয়ে আসছে। কালের আবর্তনে এবং সময়ের বিবর্তনে প্রকৃত সুফিদের জীবন দর্শন ও তাসাউফ দর্শনকে নানান ভ্রান্ত মতবাদীরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে বিকৃতি সাধনের মাধ্যমে বাউলবাদ, লালনবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও খ্রিস্টীয়বাদ ঢুকিয়ে তাসাউফ চর্চাকে বিতর্কিত করে চলছে। আল্লাহ আমাদের এ সমস্ত ভণ্ডামী থেকে হেফাজত করুক। আমিন।
লেখক: কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
(গবেষক ও ব্যাংকার)
বিআলো/তুরাগ