হাত-পায়ের তালু ঘামা: কারণ, সমস্যা ও কার্যকর প্রতিকার
ডা. তৌফিক সুলতান: মানবদেহে ঘাম একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ও বিপাকীয় ভারসাম্য বজায় রাখে। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, হাত ও পায়ের তালুতে অতিরিক্ত ঘাম হয়- যা কোনো পরিশ্রম বা গরমের কারণে নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে একে বলা হয় “পামার ও প্লান্টার হাইপারহাইড্রোসিস (Palmar and Plantar Hyperhidrosis)”।
চিকিৎসকরা জানান, এটি শুধু শারীরিক অস্বস্তিই নয়, বরং মানসিক চাপ, সামাজিক লজ্জা ও দৈনন্দিন কাজের জটিলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কারণ ও প্রেক্ষাপট-
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থার মূল কারণ হলো সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের অতিসক্রিয়তা। স্বাভাবিক অবস্থায় এই স্নায়ুতন্ত্র ঘর্মগ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করে; কিন্তু যখন এটি অস্বাভাবিকভাবে সক্রিয় হয়, তখন অতিরিক্ত ঘাম উৎপন্ন হয়- বিশেষ করে হাত ও পায়ের তালুতে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের এ সমস্যা আছে, তাদের প্রায় অর্ধেকের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও একই সমস্যা দেখা যায়- অর্থাৎ এটি অনেক সময় বংশগতভাবেও ছড়াতে পারে।
এছাড়া হরমোনের পরিবর্তন (কৈশোর, গর্ভাবস্থা, মেনোপজ), থাইরয়েডের অতিসক্রিয়তা (Hyperthyroidism), ডায়াবেটিস, স্থূলতা ও মানসিক উদ্বেগ থেকেও এই সমস্যা হতে পারে। কারও ক্ষেত্রে দেখা যায়, সাক্ষাৎকার বা গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে উপস্থিত হলে হাত-পা ঘামতে শুরু করে- এটিকে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারহাইড্রোসিস।
জীবনের ওপর প্রভাব-
প্রথমে তুচ্ছ মনে হলেও সময়ের সঙ্গে এই সমস্যা দৈনন্দিন জীবনে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
কলম পিছলে যাওয়া, কাগজ ভিজে যাওয়া, মোবাইল ব্যবহার বা করমর্দনে অস্বস্তি- সবই এর প্রভাব। এমনকি পায়ের ঘামের কারণে দুর্গন্ধ বা ছত্রাক সংক্রমণও দেখা দিতে পারে। অনেকে এতে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে সামাজিক জীবন থেকে দূরে সরে যান।
চিকিৎসা ও প্রতিকার-
সুসংবাদ হলো, এ রোগের কার্যকর চিকিৎসা এখন দেশে সহজলভ্য।
প্রথম ধাপ হলো টপিকাল থেরাপি- অর্থাৎ অ্যান্টিপারসপিরেন্ট ব্যবহার। এতে ব্যবহৃত হয় অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড হেক্সাহাইড্রেট (Aluminum Chloride Hexahydrate), যা ঘর্মগ্রন্থিকে সংকুচিত করে ঘাম কমায়। বাজারে “Drysol” ও “Driclor” নামে প্রস্তুতিগুলো পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় ধাপে আয়োনটোফোরেসিস (Iontophoresis) চিকিৎসা। এতে হাত বা পা পানিতে ডুবিয়ে হালকা বৈদ্যুতিক প্রবাহ দেওয়া হয়, ফলে ঘর্মগ্রন্থি কিছু সময়ের জন্য নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। নিয়মিত করলে এর প্রভাব স্থায়ী হয়।
যদি এতে কাজ না হয়, চিকিৎসকরা Anticholinergic শ্রেণির ওষুধ যেমন Glycopyrrolate বা Oxybutynin দিতে পারেন। তবে মুখ শুকিয়ে যাওয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এসব ওষুধ গ্রহণ করা উচিত নয়।
আরও উন্নত চিকিৎসা হলো বোটক্স ইনজেকশন (Botulinum Toxin Type A), যা ঘর্মগ্রন্থির স্নায়ু সংযোগ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এতে ৬–৮ মাস পর্যন্ত ঘাম নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটি কার্যকর হলেও তুলনামূলক ব্যয়বহুল।
সবশেষ বিকল্প হিসেবে রয়েছে এন্ডোস্কোপিক থোরাসিক সিমপ্যাথেকটমি (ETS) সার্জারি। এতে বুকে অবস্থিত সিমপ্যাথেটিক স্নায়ু কেটে বা ক্লিপ দিয়ে ঘামের প্রবাহ বন্ধ করা হয়। তবে এতে শরীরের অন্য অংশে অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার ঝুঁকি থাকায় এটি শেষ উপায় হিসেবেই বিবেচিত।
জীবনযাপনে পরিবর্তনও জরুরি-
শুধু ওষুধ নয়, কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করেও হাত-পা ঘামা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়-
* হাত-পা সবসময় পরিষ্কার ও শুকনো রাখা
* তুলার মোজা ও বাতাস চলাচলকারী জুতা ব্যবহার
* ক্যাফেইন, গরম ও মশলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা
* পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা
* নিয়মিত ধ্যান ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা
* চিকিৎসা নয়, লজ্জাই বাধা
বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেকেই লজ্জার কারণে চিকিৎসকের কাছে যান না। অথচ এটি কোনো লজ্জার বিষয় নয়- বরং চিকিৎসাযোগ্য একটি অবস্থা।
ডা. তৌফিক সুলতান বলেন, “ঘাম কোনো অভিশাপ নয়, বরং শরীরের এক প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া। সঠিক চিকিৎসা ও সচেতন জীবনযাপনই এই সমস্যাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।”
লেখক: ডা. তৌফিক সুলতান, প্রভাষক, ব্রেভ জুবিলেন্ট স্কলার্স অফ মনোহরদী মডেল কলেজ (বিজেএসএম মডেল কলেজ), মনোহরদী, নরসিংদী।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ওয়েল্ফশন মানবকল্যাণ সংঘ, কাপাসিয়া, গাজীপুর।
বিআলো/শিলি



