জান্নাতের সুখ শান্তি:মাস্টার রফিকুল ইসলাম রানা
জান্নাত আরবি শব্দ এর অর্থ বাগান। জান্নাত শব্দের মৌলিক অর্থ হচ্ছে গোপন বা আবৃত থাকা। বাগান যেহেতু গাছপালা দ্বারা আবৃত থাকে তাই বাগানকে জান্নাত বলা হয়। আর পরকালের বেহেস্ত অসংখ্য নেয়ামত দ্বারা আবৃত তাই তাকে জান্নাত নামে নামকরণ করা হয়েছে। ইসলামী পরিভাষায় জান্নাত বলা হয় ওই স্থান বা ঘরকে যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় বান্দাদের জন্য রেখেছেন, যা দিগন্ত বিস্তৃত এর মধ্যে রয়েছে অফুরন্ত ও অসংখ্য সব ধরনের নেয়ামত, চিরস্থায়ী অনাবিল সুখ-শান্তি ও আনন্দ, যার তলদেশ দিয়ে বয়ে গেছে বিভিন্ন ঝরনাধারা। জান্নাত চিরশান্তির স্থান, মানুষ ও জিনদের চরম অন্তহীন চাওয়া-পাওয়া পরম সুখ-শান্তি ও ভোগ-বিলাসের অকল্পনীয় পূর্ণতা লাভের একমাত্র স্থান। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় আমাদের প্রেরণ করেছেন একটি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য এই পরীক্ষায় যদি আমরা উত্তীর্ণ হতে পারি তাহলে আল্লাহ আমাদের জান্নাত দান করবেন আর যদি দুনিয়ার মায়ায় পরে আল্লাহকে ভুলে যাই তাহলে আমাদের জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি আমরা দুনিয়ায় জীবন পরিচালনা করার জন্য পড়াশুনা করে থাকি এসএসসি/এইচএসসি/অনার্স/মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে থাকি। যদি কোন ছাত্র পড়াশুনা না করে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে এবং খাতায় কিছু না লিখে তা হলে ঐ ছাত্রের রেজাল্ট যেমনি ফেল আসবে, ঠিক তেমনি ভাবে আল্লাহ যে নির্দেশনা বা গাইড লাইন দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন তা যদি আমাদের হায়াতে জিন্দেগীতে পালন না করি তা হলে জাহান্নামে যেতে হবে, আর যদি পালন করি তাহলে চির সুখ জান্নাতে যেতে পারব। আল্লাহ তায়ালা সুরা আলে-ইমরানের ১৪ নাম্বার আয়াতে বলেন :
মানুষের জন্য নারী, সন্তান, সোনা-রূপার স্তূপ, সেরা ঘোড়া, গবাদী পশু ও কৃষি ক্ষেতের প্রতি আসক্তিকে বড়ই সুসজ্জিত ও সুশোভিত করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সামগ্রী মাত্র। প্রকৃতপক্ষে উত্তম আবাস তো রয়েছে আল্লাহর কাছে।
এগুলো আমাদের জন্য আল্লাহর নেয়ামত এই নেয়ামতগুলো সঠিক ব্যবহার করতে পারি তাহলে চিরসুখের স্থান জান্নাত পাবো। নারী জাতির প্রতি ভালোবাসা, সন্তান সন্তুতি, কাঁড়ি কাঁড়ি সোনা রূপা, পছন্দসই ঘোড়া, গৃহপালিত জন্তু ও যমীনের ফসল (সব সময়ই) মানব সন্তানের জন্যে লোভনীয় করে রাখা হয়েছে, (অথচ) এ সব হচ্ছে পার্থিব জীবনের কিছু ভোগের সামগ্রী মাত্র! (স্থায়ী জীবনের) উৎকৃষ্ট আশ্রয় তো একমাত্র আল্লাহ তায়ালার কাছেই রয়েছে।
সুরা আল ইমরানের ১৪ নাম্বার আয়াত নাযিল হওয়ার পরে হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি যখন দুনিয়াকে এত আকর্ষণীয় বস্তু দ্বারা সৌন্দর্য মন্ডিত করেছ, আর আমরা দুনিয়ার এ সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে মুগ্ধ। তবে এখন আমাদের কী হবে? তখন এ সুরা ১৫ নাম্বার আয়াত নাজিল হয়।
বলো, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেবো, ও গুলোর চাইতে ভালো জিনিস কি? যারা তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করে তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে বাগান, তার নিম্নদেশে ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরন্তর জীবন লাভ করবে। পবিত্র স্ত্রীরা হবে তাদের সঙ্গিনী এবং তারা লাভ করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহ তার বান্দাদের কর্মনীতির ওপর গভীর ও প্রখর দৃষ্টি রাখেন।
মূল আরবি বাক্যে ‘আযওয়াজ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে ‘যওজ’। এর অর্থ হচ্ছে ‘জোড়া’। এ শব্দটি স্বামী ও স্ত্রী উভয় অর্থে ব্যবহার করা হয়। স্বামীর জন্য স্ত্রী হচ্ছে ‘যওজ’। আবার স্ত্রীর জন্য স্বামী হচ্ছে ‘যওজ’। তবে আখেরাতে ‘আযওয়াজ’ অর্থাৎ জোড়া হবে পবিত্রতার গুণাবলী সহকারে। যদি দুনিয়ায় কোন সৎকর্মশীল পুরুষের স্ত্রী সৎকর্মশীলা না হয় তাহলে আখেরাতে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ওই সৎকর্মশীল পুরুষটিকে অন্য কোন সৎকর্মশীলা স্ত্রী দান করা হবে। আর যদি দুনিয়ায় কোন স্ত্রী হয় সৎকর্মশীলা এবং তার স্বামী হয় অসৎ তাহলে আখেরাতে ওই অসৎ স্বামী থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে কোন সৎপুরুষকে তার স্বামী হিসেবে দেয়া হবে। তবে যদি দুনিয়ায় কোন স্বামী-স্ত্রী দু’জনই সৎকর্মশীল হয় তাহলে আখেরাতে তাদের এই সম্পর্কটি চিরন্তর ও চিরস্থায়ী সম্পর্কে পরিণত হবে।
আয়াতের শেষ অংশের ব্যাখ্যা : আল্লাহ অপাত্রে দান করেন না। উপরি উপরি বা ভাসা ভাসা ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তার নীতি নয়। তিনি তার বান্দাহদের কার্যাবলী, সংকল্প ও ইচ্ছা পুরোপুরি ও ভালোভাবেই জানেন। কে পুরস্কার লাভের যোগ্য আর কে যোগ্য নয়, তাও তিনি ভালোভাবেই জানেন। জান্নাতি ব্যাক্তিদের খাবারের অভাব থাকবে না খেতে থাকবে কিন্তু পায়খানা প্রশাবের দরকার হবে না এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারা ২৫নাম্বার আয়াতে বলেন :
‘যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, আপনি তাদের এমন বেহেশতের সুসংবাদ দিন, যার পাদদেশে নদী প্রবাহমান থাকবে। যখনই তারা খাবার হিসেবে কোন ফল প্রাপ্ত হবে, তখনই তারা বলবে, এতো অবিকল সে ফলই যা আমরা ইতোপূর্বেও লাভ করেছিলাম। বস্তুতঃ তাদের ইহকালের অনুরূপ ফল প্রদান করা হবে এবং সেখানে তাদের জন্য পবিত্র রমণীকূল থাকবে। আর সেখানে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে।’
জান্নাতের তলদেশ দিয়ে নদী বয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে তার বৃক্ষরাজী ও অট্টালিকার নিম্নদেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া। হাদীস শরীফে আছে যে, তথায় নদী প্রবাহিত হয়, কিন্তু গর্ত নেই। অন্য হাদীসে আছে যে, কাওসার নদীর দু’ধারে খাঁটি মুক্তার গম্বুজ আছে, তার মাটি হচ্ছে খাঁটি মৃগনাভি, তার কুচি পাথরগুলো হচ্ছে মণি-মুক্তা ও অতি মূল্যবান পাথর। আল্লাহ্ তা’আলা অনুগ্রহ করে যেন আমাদের ওই নিয়ামত দান করেন। তিনি বড় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু। হাদীসে আছে যে, জান্নাতের নদীগুলো মুশকের পাহাড়ের নিম্নদেশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিম)। হযরত আবদুল্লাহ্ (রাঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। জান্নাতবাসীদের এই কথা ‘ইতিপূর্বে আমাদের দেয়া হয়েছিল। এর ভাবার্থ এই যে, দুনিয়াতেও তাদের এইগুলো দেয়া হয়েছিল। তাদের এটা বলার কারণ এই যে, বাহ্যিক আকারে এটা সম্পূর্ণ সাদৃশ্যপূর্ণ হবে। ইয়াহ্ইয়া বিন কাসীর (র.) বলেন যে, এক পেয়ালা আসবে, তা সে খাবে আর এক পেয়ালা আসলে বলবে : ‘এটা এতো এখন খেলাম।’ ফেরেশতারা বলবেন : ‘খেতে থাকুন। বরং এক হলেও স্বাদ আলাদা। তিনি আরও বলেন যে, বেহেশতের ঘাস হচ্ছে জাফরান এবং পাহাড়গুলো হচ্ছে মুশকের। ছোট ছোট সুন্দর ছেলেরা ফল এনে হাজির করছে এবং তারা খাচ্ছে। আবার আনলে তারা বলছে : ওটা এখনই তো খেলাম।’ তারা উত্তর দিচ্ছে ” জনাব! রং ও রূপ তো এক, কিন্তু স্বাদ পৃথক; খেয়ে দেখুন।’ খেয়েই তারা আরও সুস্বাদু অনুভব করছে। সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার এটাই অর্থ। দুনিয়ার ফলের সঙ্গেও নামে ও আকারে সাদৃশ্য থাকবে, কিন্তু স্বাদ হবে পৃথক। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন যে, সাদৃশ্য শুধু নামে হবে, নচেৎ কোথায় এখানকার জিনিস আর কোথায় ওখানকার জিনিস। এখানে তো শুধু নামই আছে। আবদুর রহমানের (রা.) কথা এই যে, দুনিয়ার ফলের মত ফল দেখে বলবে : ‘এটা তো খেয়েছি। কিন্তু যখন খাবে তখন বুঝবে যে, মজা অন্য কিছু। তথায় তারা যেসব স্ত্রী পাবে তারা মলিনতা, অপবিত্রতা, মাসিক ঋতু, প্রস্রাব, পায়খানা, থুথু ইত্যাদি হতে সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে।
আল্লাহ তায়ালা জান্নাতিদের খাবারের ব্যাপারে সুরা মোহাম্মাদের ১৫ নাম্বার আয়াতে বলেন : মুত্তাকীদের জন্য যে জান্নাতের প্রতিশ্রতি দেয়া হয়েছে তার অবস্থা এই যে, তার মধ্যে স্বচ্ছ ও নির্মল পানির নহর বইতে থাকবে। এমন সব দুধের নহর বইতে থাকবে যার স্বাদে সামান্য কোন পরিবর্তন বা বিকৃতিও আসবে না, শরাবের এমন নহর বইতে থাকবে পানকারীদের জন্য যা হবে অতীব সুস্বাদু এবং বইতে থাকবে স্বচ্ছ মধুর নহর। এছাড়াও তাদের জন্য সেখানে থাকবে সব রকমের ফল এবং তাদের রবের পক্ষ থেকে থাকবে ক্ষমা। (যে ব্যক্তি এ জান্নাত লাভ করবে সেকি) ওই ব্যক্তির মত হতে পারে যে চিরদিন জাহান্নামে থাকবে, যাদের এমন গরম পানি পান করানো হবে যা তাদের নাড়িভুড়ি ছিড়ে যাবে। (চলবে)
শিক্ষক, তানযীমুল উম্মাহ হিফয মাদরাসা, নারায়ণগঞ্জ শাখা।