এমপি আনার হত্যা: হত্যার ছক ১৯৯৮ সালে, ২৬ বছর পর কার্যকর
বিআলো ডেস্ক: ভারতের কলকাতায় সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের ১০ মাস পরেও তদন্তের গতি ধীর। পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিবর্তন তিনবার হলেও, বর্তমানে তদন্ত আটকে রয়েছে ডিএনএ রিপোর্টের জন্য, যা ভারতের পুলিশের কাছ থেকে এখনও আসেনি।
তদন্তকারীরা জানান, আজীম হত্যার পরিকল্পনা প্রথমে ১৯৯৮ সালে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় অধিবেশনে হয়, যেখানে তাকে মাদক কারবারি, স্বর্ণ চোরাকারবারি এবং জমি দখলকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ২৬ বছর পর ২০২৪ সালে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে পার্টির সদস্যরা।
তদন্তের তথ্য অনুযায়ী, হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহিন, যিনি ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে আজীমকে টার্গেট করেন। শাহিন তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বহারা পার্টির সদস্যদের ব্যবহার করেন। আজীমকে কলকাতায় যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করেন, যেখানে সে মাদক ও অস্ত্র চোরাকারবারে জড়িত থাকার ‘টিকিট’ নিতে যাওয়ার কথা ছিল। কলকাতার নিউ টাউনে একটি বাসা ভাড়া নেওয়া হয়, যার চুক্তিপত্রে সেলেস্তি রহমানকে তাঁর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে দেখানো হয়।
এ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া প্রধান অভিযুক্ত, আমানুল্লাহ (শিমুল ভূঁইয়া), ছয়জনের সঙ্গে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তাদের জবানবন্দি থেকে হত্যাকাণ্ডে প্রত্যেকের ভূমিকা পরিষ্কার হয়।
১৩ মে আজীম খুন হওয়ার পর, ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় জিডি করেন তার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস এবং পরবর্তীতে ১৯ মে তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় নিখোঁজের অভিযোগ করেন। এর পর থেকে তদন্তে উত্তেজনা দেখা যায়, এবং গত ২২ মে তার মেয়ে মামলা দায়ের করেন। এখন পর্যন্ত ৯ জন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এর মধ্যে ছয়জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গত ৬ মার্চ আজীমকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পেছায়। নতুন করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আগামী ২১ এপ্রিল দিন ধার্য করেছেন এম এ আজহারুল ইসলামের আদালত। এ মামলায় এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ। তারা হলেন– সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া, সেলেস্তি রহমান, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু, মোস্তাফিজুর রহমান ও ফয়সাল আলী। তাদের মধ্যে মিন্টু ছাড়া ছয়জনই দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এখন সব আসামি কারাগারে। এদিকে হত্যার পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহিন পলাতক রয়েছেন।
এমপি আজীম হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি ওয়ারী বিভাগের পরিদর্শক বাহলুল খান বাহার সমকালকে বলেন, ভারতীয় পুলিশের কাছে ডিএনএ প্রতিবেদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। ডিএনএ রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে।
হত্যা মিশনে শিমুল ভূঁইয়ার ভূমিকা-
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে শিমুল ভূইয়া জানান, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৯৮ সালে দলের কেন্দ্রীয় অধিবেশনে আজীমকে একজন ‘ঘৃণিত ও অত্যাচারী’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর পর দলের ঝিনাইদহ শাখাকে তাঁকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু শাখা সেই কাজ করতে ব্যর্থ হয়। ২০১৪ সালে এমপি হওয়ায় হত্যার সিদ্ধান্ত থেকে তারা সরে আসে। শিমুল ও শাহিন দুই মেরুর হলেও আজীমকে হত্যায় সমন্বয় চলতে থাকে। শাহিনের সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থাকলেও, ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের (আজীম ও শাহিন) ভালো সম্পর্ক ছিল। এর মধ্যে ২০২৩ সালের নভেম্বরে পরিকল্পনা হয়, সময় ও সুযোগ পেলেই হত্যা করা হবে। এর পর কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনে বাসা ভাড়া নেওয়া হয়। শাহিনের কথা মতো সেলেস্তিসহ তিনজন ৩০ এপ্রিল কলকাতায় যান।
সঞ্জীবায় গিয়ে অবস্থান করার সময় শাহিন ৫ থেকে ৬ মে মোবাইল ফোনে টাকা-পয়সা লেনদেনের বিষয়ে কথা বলছিলেন। এ সময় শাহিনকে জিজ্ঞেস করলে জানান, আজীমকে হত্যার জন্য ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম মিন্টু ২ কোটি টাকা দেবেন। তার মধ্য ২০ লাখ টাকা দেশে গেলে পাওয়া যাবে। বাকি ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ২৬ থেকে ৩১ মের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়া মিন্টু এলএম পার্টির জন্য সব সময় আর্থিক সহায়তা দেবেন। প্রথম কিস্তির টাকা নেওয়ার জন্য গ্যাস বাবুকে আজীমের ছবি পাঠাতে হবে। ছবিটি দেখার পর টাকা পৌঁছাবে নির্দিষ্ট ঠিকানায়। ফয়সাল, মুস্তাফিজ ও জিহাদ পার্টির কর্মী। জিহাদ আগে থেকেই কলকাতায় আছে। সঞ্জীবা গার্ডেনে দু’দিন থাকার পর পরিস্থিতি দেখে এখানে কাজ করা সম্ভব নয় জানালে বাসার সিসি ক্যামেরা নষ্ট বলে জানান শাহিন। পরে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া জিহাদ, ফয়সাল ও মুস্তাফিজ বাসায় আসে। সিয়ামকে দিয়ে সব সরঞ্জাম কিনে বাসায় নিয়ে আসেন শাহিন। সূত্র: দৈনিক সমকাল
বিআলো/শিলি