ইবাদত পালনে চলমান বিভ্রান্তি নিরসনের লক্ষে দালিলিক পর্যালোচনা সভা করেছে দাওয়াতুস সুন্নাহ
নিজস্ব প্রতিবেদক: সারাদেশে একই দিনে রোজা-ঈদ ও কুরবানি সহ চাদের তারিখ নির্ভর সকল ইবাদত পালনে চলমান বিভ্রান্তি নিরসনের লক্ষে দালিলিক পর্যালোচনা সভা করেছে দাওয়াতুস সুন্নাহ বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন।
১লা জুন (রবিবার) ঢাকা রিপোর্টাস হস্তানটি সাগর রুনি মিলনায়তনে দাওয়াতুস সুন্নাহ বাংলাদেশের উদ্দ্যোগে আয়োজিত পর্যালোচনা সভায় উপস্থাপিত বক্তব্যের শারাংশ।
নাহমাদুহ ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিছিল কারীম আম্মাবাদ।
সম্মানিক সুধীমন্ডলী।
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি আপনাদের সকলের। বিশেষ করে সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, আলোচকবৃন্দ এবং সম্মানিত সাংবাদিক ভাইদের, যারা অক্লান্ত কষ্ট করে নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমাদের আজকের আযোজনে এসে আমাদেরকে ধন্য করেছেন। আল্লাহ তাআলা আপনাদের সকলকে উত্তম ও পরিপূর্ণ বদলা দান করুন।
প্রিয় উপস্থিতি। আমাদের আজকের এই পর্যালোচনা সভা আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য এবং কারণ হচ্ছে, আমরা দেখছি বাংলাদেশে কিছু মানুষ রমজানের রোজা, আরাফার রোজা, ঈদ, কোরবানিসহ চন্দ্র তারিখ নির্ভর সকল ইবাদতের সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে এক ধরনের বিভ্রান্তি ও জটিলতা অনুভব করেন।
কেউ মনে করেন সৌদির সাথে মিল রেখে রোজা-ঈদ পালন করতে হবে।
আবার কেউ মনে করেন এখন আর চাঁদ দেখার কোন প্রয়োজনীয়তা নাই। জ্যোতিবিজ্ঞানের হিসাব তথা লুনার ক্যালেন্ডার বা হিজরী ক্যালেন্ডার মোতাবেক এগুলো পালন করতে হবে।
আবার কারো কারো বক্তব্য পৃথিবীর যে কোন দেশে চাঁদ দেখা গেলে তার সংবাদের ভিত্তিতে সবাইকে রোজা ঈদ পালন করতে হবে, ইত্যাদি।
আবার আমরা বলি নিজ নিজ অঞ্চলে চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে বোজা ঈদ পালন করতে হবে।
এ সকল বিষয়াবলির কারণে বাংলাদেশে কিছু সাধারণ মানুষের মধ্যে রোজা ঈদ পালনের ব্যাপারে এক ধরনের বিভ্রান্তি এবং অস্থিরতা বিরাজ করছে। চলমান এই অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি দূর করে সঠিক পথ দেখানোর লক্ষ্যে আজকের এ পর্যালোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ। আমরা আশা করি আমাদের সম্মানিত অতিথি ও আলোচকদের আলোচনার মাধ্যমে আপনারা এই
নিময়ে পরিষ্কার ধারণা পেয়েছেন।
প্রিয় সুধী ও সাংবাদিক ভাইয়েরা। আপনাদের মাধ্যমে আমরা সকল মুসলমানদের কাছে পরিষ্কার ভাবে এ মেসেজ পৌঁছাতে চাই যে, রোজা ঈদ পালনের বিষয়টি চাঁদ দেখার সাথেই সম্পৃক্ত। লোনার ক্যালেন্ডার বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের সাথে সম্পৃক্ত নয়।
আর এটিই ইসলামের বিধান। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
তোমরা চাঁদ দেখে রোজা শুরু করবে এবং চাঁদ দেখে রোজা ছাড়বে। আকাশ যদি মেঘে ঢাকা থাকে তাহলে শাতাদের গণনা ত্রিশ দিন পুরা করবে। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৯০৯)
অপর এক হাদীসে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু সম্রাম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এরশাদ করেন-
তোমরা চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোজা শুরু করবে না এবং শাওয়ালের চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোজা অব্যাহত রাখবে। যদি আকাশ মেঘাষন্ন হয় তবে রোজা ত্রিশ দিন পূর্ণ’ করবে, অতঃপর রোজা ভঙ্গ করবে। আর মাস উনত্রিশ দিনেও
হয়। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ২৩২৭)
অপরদিকে আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন ইসলামের সূচনা ভাল অর্থাৎ নববী যুগ, সাহাবা যুগ, তাবেঈ যুগ থেকে অদ্যবধি সমগ্র বিশ্বের আলেম-ওলামা, মুসলিম জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি বর্গসহ সকলেই এই বিধানের উপর নিরবিধিয় ভাবে তামল করে আসছেন।
প্রিয় উপস্থিতি। পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে চাঁদ দেখা গেলে ঐ চাঁদের সংবাদের ভিত্তিতে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের উপর ব্রোমা ঈিদ পালন করা আবশ্যক কিনা, এ ব্যাপারে পূর্বসূরী উলামা ও ফকীহগন থেকে দু ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়।
প্রথম বক্তব্য। দূর-দূরান্তের শহর-নগরের কোন এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অবশ্য অনুসরণীয়। কিন্তু এই ফতোয়ার উপর সারা বিশ্বের মানুষ আজও পর্যন্ত আমল করতে পারেনি। অর্থাৎ একসাথে রোজা ঈদ পালন করতে পারেনি। কারণ তখন থেকে ইন্টারনেট আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না থাকার ফলে মানুষ জানত না দূর দূরান্তের দেশের চাঁদের সংবাদ।
আর বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলেও সময়ের ব্যবধানজনিত সমস্যার কারণে এই ফতোয়ার ওপর আমল করা সম্ভব হচ্ছে না।
দ্বিতীয় বক্তব্য: দূর-দূরান্তের শহর-নগরের কোন এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অবশ্য অনুসরণীয় নয়। আর এই ফতোয়ার উপরেই ১৪০০ বছর যাবত আমল চলে আসছে। আর বর্তমানেও সমগ্র বিশ্বের
মুসলমানগণ এই ফতোয়ার উপরই আমল করে যাচ্ছেন। যার কয়েকটি দৃষ্টান্ত আমি আপনাদের সামনে পেশ করছি-
* ২০১৮ সালে ১৫ মে মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে রমজানের চাঁদ দেখা গিয়েছিল পৃথিবীর কোন দেশ তা গ্রহণ করেনি।
* ২০২২ সালের ঈদুল ফিতরের চাঁদ সর্বপ্রথম আফগানিস্তান, নাইজার ও মালিতে দেখা গিয়েছিল। সৌদি সহ পৃথিবীর কোন দেশের মানুষ তাদের সাথে মিল রেখে ঈদ উদযাপন করেনি। তবে সাদ্রা দরবারের একাংশ সেদিন ঈদ উদযাপন করেছিল।
২০২৫ সালের ঈদুল ফিতরের চাঁদ স্বায়ং আরব দেশগুলোতেই দু দিনে দেখা গিয়েছে। ফলে প্রত্যেকেই নিজ নিজ দেশে চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রোজা ঈদ পালন করেছেন
* ২০২৫ সালের ঈদুল আযহার চাঁদ মধ্যপ্রাচ্যে একই তারিখে দেখা গেলেও মরক্কোতে দেখা যায়নি। ফলে
তারা ৭ ই জুন ঈদুল আযহার ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রিয় সুধী। জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব তথা লোনার ক্যালেন্ডার বা হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী রোজা ঈদ পালন করাও সম্ভব নয়। কেননা তাতে রোজা ঈদ পালনের মূলনীতি “চাঁদ দেখা’কে বর্জন করা হয়।
চাঁদের জন্ম এক জিনিস এবং চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার ভিন্ন জিনিস। রোজা ঈদের সম্পর্ক চাঁদের জন্মের সাথে নয়। বরং চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার সাথে এ কথা পরিষ্কারভাবে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে।
প্রিয় সুধী। সৌদি আরব অথবা অন্য যেকোন দেশে আগে চাঁদ দেখা যায়, তাঁর সাথে গোটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশসমূহের সাথে সময়ের ব্যবধানের কারণে কোন এবাদত একসাথে মিল রেখে পালন করা সম্ভব হবে না।
তাই যেমন ভাবে নিজ নিজ অঞ্চলে নিজ নিজ সমর অনুযায়ী ইবাদত পালন করতে হয় তেমনিভাবে নিজ নিজ অঞ্চলে চাঁদ দেখার ভিত্তিতে মাসের শুরুর হিসাব করতে হবে। অন্যথায় মুসলমানদেরকে এমন বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে যার কোন সমাধান নাই। তো এবার আমাদের এ অঞ্চলে (দেশে) ৬ই জুন শুক্রবার আরাফার রোজা এবং ৭ই জুন শনিবার থেকে ঈদুল আযহা শুরু হবে ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় সুধী। আজকের এই পর্যালোচনা সভা থেকে আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই মর্মে আবেদন করছি যে, চাঁদ দেখা কমিটিকে আরো উন্নাত এবং তৎপর করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।।
সেই সাথে সকল মুসলমানদের জানা থাকা দরকার যে, চাঁদ দেখা এটা কোন কমিটির দায়িত্ব নয়। এটা আমাদের সকলের দায়িত্ব। সুতরাং আমরা চাঁদ দেখবো এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের কাছে সংবাদ পৌঁছে দেব। তারা যাচাই-বাছাই করে ঘোষণা করবেন। চাঁদ দেখার ব্যাপারে আমাদের উদাসীনতাই এ সকল সমস্যার জন্ম দিয়েছে।
প্রিয় সুধী। আজকের এই পর্যালোচনা সভা থেকে এই কথাগুলো আপনাদের কাছে পেশ করছি। আশা করি সকল মুসলমানগন রোজা ঈদ পালনের ব্যাপারে সকল ধরনের বিভ্রান্তি এবং জটিলতা থেকে বেঁচে সুন্নাহ সম্মত পন্থায়। চাঁদের তারিখ নির্ভর সকল ইবাদত যথাযথভারে পালন করতে পারবেন, ইনশাআল্লাহ
পরিশেষে আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। গুয়ামা তাওফিকী ইল্লা বিল্লাহ।
বিআলো/নিউজ