ফেরেনি সড়ক পথের শৃঙ্খলা; ৫৯৭ দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝড়েছে ৬১৪
রতন বালো: সারাদেশে সড়ক পথের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। নিশ্চিত হয়নি সড়ক পথের শৃঙ্খলা। বিভিন্ন সময়ে বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনার পর গঠিত কমিটিগুলো নানান সুপারিশ করেছে। এর আলোকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়েছে অনেক সিদ্ধান্ত। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আবার নির্দেশনা দিতে দেখা গেছে আদালতকেও। কোন ভাবেই সড়ক পথে শৃঙ্খলা ফেরেনি, নিশ্চিত করা যায়নি নিরাপত্তা। সড়কে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা, আর ঝরছে প্রাণ।
আইন করেও দূর করা যাচ্ছে জাতীয় মহাসড়কে নসিমন, করিমন, ভটভটি, রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহন। আর এ কারণেই ফের বাড়ছে সড়ক দুঘর্টনা। সড়ক দুর্ঘটনা অপ্রত্যাশিত হলেও তা নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ মতে, মে মাসে সড়ক দুর্ঘটনার ৬ কারণ উল্লেখকরা হয়েছে।
কারণগুলো হচ্ছে:
১. দেশের সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত রিক্সা অবাধ চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব কারণ দূর করতে হবে। ২. জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কবাতি না থাকায় হঠাৎ যাতায়াতকারী ব্যক্তিগত যানের চালকদের রাতে এসব জাতীয় সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালানো। ৩. জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টার্নিং চিহ্ন না থাকার ফলে নতুন চালকের এসব সড়কে দুঘটনায় পতিত হয়েছে। ৪. মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা। ৫. উল্টোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাঁদাবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন। ৬. অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, বেপরোয়া যানবাহন চালানো এবং একজন চালক অতিরিক্ত সময় ধরে যানবাহন চালানো।
এসব কারণ প্রতিরোধে দশ (১০) সুপারিশ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এই সুপারিশ সমূহ বাস্তবায়ন করা হলে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ কমে যাবে বলেও দাবি করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
দাবিগুলো হলো:
১. জরুরি ভিত্তিতে মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা, ২. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতের বেলায় অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা, ৩. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, যানবাহনের ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফিটনেস প্রদান, ৪. ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা, ৫. সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা, ৬. মহাসড়কে ফুটপাত ও পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা রাখা, রোড সাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা, ৭. সড়ক পরিবহন আইন যথাযতভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা, ৮. উন্নতমানের আধুনিক বাস নেটওর্য়াক গড়ে তোলা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, ৯. মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেইফটি অডিট করা ও ১০. মেয়াদোত্তীর্ণ গণপরিবহন ও দীর্ঘদিন যাবৎ ফিটনেসহীন যানবাহন স্ক্যাপ করার উদ্যোগ নেওয়া।
দুর্ঘটনার ছয় (৬) কারণ ও দশ (১০) সুপারিশ বাস্তবায়ন না করার কারণে সড়কপথের দুর্ঘটনা দিনে দিনে বাড়ছে। গত মে মার্চ মাসে দেশের গণমাধ্যমে ৫৯৭ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝড়েছে ৬১৪ এবং আহত ১ হাজার ১৯৬ জনের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এ দুর্ঘটনার মধ্যে রেলপথে ৪৮টি দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝড়েছে ৩৫ এবং আহত হয়েছে ১৪ জন।
তথ্যমতে, নৌ পথে ৭টি দুর্ঘটনায় ৯ জনের প্রাণ ঝড়েছে এবং ১০ জন নিখোঁজ রয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে সর্বমোট ৬৫২টি দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝড়েছে ৬৫৮ এবং ১ হাজার ২১০ জন আহত হয়েছে। এই সময়ে ২৩৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝড়েছে ২৫৬ এবং ২০১ জন আহত হয়েছে। যা মোট দুর্ঘটনার ৩৯.০২ শতাংশ, নিহতের ৪১.৬৯ শতাংশ ও আহতের ১৬.৮০ শতাংশ।
গত মে মাসে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে ঢাকা বিভাগে ১৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝড়েছে ১৪৮ এবং ২৭১ জন আহত হয়েছে, সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে বরিশাল বিভাগে ৩০টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝড়েছে ৩০ এবং ৪৪ জন আহত হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

আজ বৃহস্পতিবার সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই প্রতিবেদন তুলে ধরে সংগঠনটি। দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সড়ক, রেল ও নৌ পথের দুর্ঘটনার সংবাদ মনিটরিং করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
জানা গেছে, সড়কে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ৭ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ১৫৪ চালক, ১০৩ পথচারী, ৬৭ পরিবহন শ্রমিক, ৯২ শিক্ষার্থী, ৫ শিক্ষক, ৮৮ নারী, ৫৮ শিশু, ৩৭ সাংবাদিক, ২ চিকিৎসক, ১ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ৭ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর পরিচয় মিলেছে।
এদের মধ্যে ২ পুলিশ সদস্য, ১ সেনাবাহিনী সদস্য, ১ ফায়ার সার্ভিস সদস্য, ২ জন চিকিৎসক, ১ জন মুক্তিযোদ্ধা, ১৪২ বিভিন্ন পরিবহনের চালক, ৯৫ পথচারী, ৫৯ নারী, ৫৪ শিশু, ৬৬ শিক্ষার্থী, ৩৪ পরিবহন শ্রমিক, ৫ শিক্ষক ও ৭ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর প্রাণ ঝড়িয়েছে।
এই সময় সড়ক দুর্ঘটনায় সংগঠিত ৯৪৫ যানবাহনের পরিচয় মিলেছে। এতে দেখা যায়, ২৯.৪১ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২২.৫৩ শতাংশ ট্রাক-পিকাপ-কাভার্ডভ্যান ও লরি, ১২.৪৮ শতাংশ বাস, ১৪.১৭ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ৬.৬৬ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, ৯.৩১ শতাংশ নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা-ট্রাক্টর ও লেগুনা, ৫.৩৯ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস সড়কে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।
সংগঠিত মোট দুর্ঘটনার ৪৯.০৭ শতাংশ গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা, ২৪.৯৫ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২০.১০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে, ৫.০২ শতাংশ বিবিধ কারণে, চাকায় ওড়না পেছিয়ে ০.৩৩ শতাংশ, এবং ০.৫০ ট্রেন-যানবাহনের সংঘর্ষে ঘটে।
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই মাসে সংগঠিত মোট দুর্ঘটনার ৩৩.৫০ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩২.৮৩ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৮.১৪ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়াও সারা দেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৩.৫১ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ১.৫০ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও ০.৫০ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংগঠিত হয়েছে।
বিআলো/তুরাগ