এসএমই দিবসে আলোচনায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দুরবস্থা ও সম্ভাবনার কথা বললেন আতিকুর রহমান
নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্ব এসএমই দিবস উপলক্ষে এক আলোচনায় দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (সিএমএসএমই) সমস্যাবলী এবং সম্ভাবনা তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আতিকুর রহমান।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে প্রায় ৭৮ লাখ উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা নানাবিধ নীতি-সংকট, ব্যাংক ঋণ সহায়তার অভাব, গবেষণা ও নকশার ঘাটতি, দক্ষ জনবল ও পরিকল্পনার অভাবের মধ্যেও নিজেদের উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় আড়াই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে, কিন্তু অর্থনীতির মূলধারায় এই বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত।”
আতিকুর রহমান বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত নিয়ে আমরা অনেক পরিকল্পনা করি, তবে কটেজ, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তারা নীতিগতভাবে বঞ্চিতই থেকে যান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী মূলত মাঝারি উদ্যোক্তারাই সব সুবিধা পান। ব্যাংকগুলোও আগ্রহী থাকে বড়, প্রতিষ্ঠিত ও মূলধনী উদ্যোক্তাদের নিয়ে। ফলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়ছেন।
চারকোল রপ্তানি শিল্পের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “২০১২ সালে আমরা কয়েকজন ব্যবসায়ী চীনের সহযোগিতায় দেশে চারকোল উৎপাদন শুরু করি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই পণ্য থেকে ২৫০ কোটি টাকার রপ্তানি হয়েছে। অথচ এই চারকোলকে ‘অ্যাকটিভেটেড’ করে যদি ফটোকপিয়ারের কালি, কম্পিউটার কালি, মোবাইল ব্যাটারি, টায়ার, কসমেটিকস ও পেস্টের মতো ডাইভারসিফাইড পণ্য তৈরি করা যায়, তাহলে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব। এতে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।”
তিনি বলেন, দেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান এখনো ২৫-২৭ শতাংশের মধ্যে সীমিত, যেখানে উন্নত দেশে তা ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত। ২০১৯ সালে সরকার এসএমই নীতিমালা প্রণয়ন করলেও তা বাস্তবে সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের অনুকূলে প্রয়োগ হয়নি। বরং বড় ও মাঝারি শিল্পগোষ্ঠী এর সুবিধা বেশি নিয়েছে।
আতিকুর রহমান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “সিএমএসএমই খাতের জন্য আলাদা ও বাস্তবভিত্তিক সংজ্ঞা দরকার। কটেজ, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড়—সবাইকে এক ছাতার নিচে রাখলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা হারিয়ে যায়। ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করতে হবে যেন তারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরও সহায়তা করে।”
এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে যাচ্ছি। তখন আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা ও রপ্তানির প্রতিযোগিতা বাড়বে। এই সক্ষমতা তৈরি করতে সিএমএসএমই খাতই হবে সবচেয়ে বড় শক্তি। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্যের ভিত্তি এই খাতেই রয়েছে।”
বাংলাদেশের পাটপণ্য খাতের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “বিশ্ববাজারে পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশের পাট বিশ্বমানের হলেও রপ্তানি সীমিত কয়েকটি পণ্যে। আধুনিক প্যাকেজিং, গার্ডেনিং আইটেম, অটোমোবাইল পার্টস, হোম ডেকর বা প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য তৈরিতে আমরা পিছিয়ে। এটি বদলাতে গবেষণা ও নকশার উন্নয়ন দরকার।”
তিনি বলেন, সরকার চাইলে একটি কেন্দ্রীয় ‘ডিজাইন ব্যাংক’ করতে পারে, যেখানে উদ্যোক্তারা পেশাদার নকশা পাবেন। একই সঙ্গে দেশের প্রতিটি জেলায় উদ্যোক্তা ম্যাপিং করা দরকার—কারা কোন খাতে কাজ করছেন, তাঁদের দক্ষতা, কাঁচামাল, বাজারের চাহিদা ও রপ্তানির সম্ভাবনা কী—তা নির্ধারণ করে পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে চীন, ভারত, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ইতিমধ্যেই উদাহরণ তৈরি করেছে।
আতিকুর রহমান বলেন, “সরকার যদি আগামী পাঁচ বছরে প্রতি জেলায় ১০ হাজার উদ্যোক্তাকে চিহ্নিত করে তাঁদের দক্ষতা উন্নয়ন, বাজার সংযোগ, সহজ শর্তে ঋণ ও প্রযুক্তি সহায়তা দেয়, তাহলে রপ্তানি আয় কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব।”
সবশেষে তিনি বলেন, “এই খাতের জন্য দরকার একটি সমন্বিত জাতীয় রোডম্যাপ। যেখানে থাকবে—১. জেলা-উপজেলা পর্যায়ে উদ্যোক্তা ম্যাপিং, ২. খাতভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন, ৩. গবেষণা ও ডিজাইন সাপোর্ট, ৪. ব্যাংকিং সহায়তা সহজীকরণ, ৫. নীতিমালা বাস্তবায়ন তদারকি, ৬. রপ্তানিতে বৈচিত্র্য এবং ৭. বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বিদেশে কর্মরত কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের মাধ্যমে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ পণ্যের প্রচার।”
তিনি বলেন, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে কেবল পাট নয়, হাজারো উদ্যোক্তার শ্রম ও মেধা দেশের অর্থনীতিকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যাবে।
বিআলো/তুরাগ