ভুট্টা হতে পারে অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’,প্রয়োজন শুধু সঠিক পরিকল্পনার : প্রজ্ঞা দাস
dailybangla
10th Jul 2025 4:27 pm | অনলাইন সংস্করণ
বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে ভুট্টা একটি উদীয়মান ফসল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে না বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। ধান ও গমের পাশাপাশি ভুট্টা এখন কৃষকদের কাছে লাভজনক এবং টেকসই ফসল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভুট্টা উৎপাদনের অভূতপূর্ব সাফল্য দেশের অর্থনীতিতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এই ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে আমদানি নির্ভরতা কমছে এবং রপ্তানির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হচ্ছে। সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এবং বাজার সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করতে পারলে ভুট্টা হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেবার একটি মাধ্যম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে ভুট্টার উৎপাদন ৬৬ লাখ টনের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) ৬৮.৮৪ লাখ টন থেকে সামান্য কম হলেও জমির ব্যবহারে দক্ষতা এবং ফলনের গুণগত মানে অভূতপূর্ব উন্নতি এসেছে। এই অর্থবছরে ভুট্টা চাষ হয়েছে ৫.৭৮ লাখ হেক্টর জমিতে, যা ২০১১-১২ অর্থবছরের ২.৮৩ লাখ হেক্টরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
এই বৃদ্ধি শুধু পরিসংখ্যানের পাতায় নয়, বরং কৃষকদের জীবনে সমৃদ্ধির নতুন রঙ এনেছে।তবে এই অর্জন সত্ত্বেও প্রতিবছর ১৫-২০ লাখ টন ভুট্টা আমদানি করতে হচ্ছে, যার পেছনে যাচ্ছে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। এই আমদানির পরিবর্তে যদি দেশীয় উৎপাদন দ্বিগুণ করা যায়, তাহলে শুধু কৃষি নয়, বাণিজ্য ও রপ্তানিও পাবে নতুন গতি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভুট্টাভিত্তিক স্টার্চ, সিরাপ, কসমেটিক্স, ওষুধ এমনকি টেক্সটাইল উপকরণ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। সেখানে বাংলাদেশ এখনো এই বাজারে অনুপস্থিত, কেননা আমরা ভুট্টাকে এখনো সম্পদ হিসেবে ভাবি না। অথচ দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা, কৃষক প্রশিক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তুলতে পারলে ভুট্টার আমদানির পরিবর্তে অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ভুট্টা এমন এক ফসল, যার প্রতিটি অংশ অর্থাৎ শস্য, খোসা, ডাঁটা, ছোবড়া কোনো কিছুই ফেলনা নয়।
এর থেকে তৈরি হয় বায়োপ্লাস্টিক, অর্গানিক সার, পশুখাদ্য, এমনকি পেপার ও টেক্সটাইল উপকরণ। এই খাতে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করলে, গ্রামের মানুষ চাকরির জন্য শহরে পাড়ি দেবে না, বরং গ্রামেই গড়ে উঠবে ক্ষুদ্র শিল্প, নারীর কর্মসংস্থান এবং একটি টেকসই পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি। তাছাড়া ভুট্টা চাষের ক্ষেত্রে সাথী ফসল চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। সেক্ষেত্রে ভুট্টার সাথে লালশাক, মূলা বা ফুলকপির চাষ, কৃষকদের আয়ের উৎস বৈচিত্র্যময় করবে এবং জমির উৎপাদনশীলতাও বাড়াবে। আগামী দশকে বিশ্বজুড়ে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, জৈবশক্তি ও পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা বাড়বে বহুগুণ। ভুট্টা তার প্রতিটি অণুতে সেই চাহিদা মেটাতে প্রস্তুত। বাংলাদেশ যদি এখনই ভুট্টাভিত্তিক স্টার্চ কারখানা, কর্ন সিরাপ ইউনিট, কর্ন অয়েল এক্সট্রাকশন, ওষুধ প্রস্তুতকারক কারখানা গড়ে তুলতে পারে, তবে ভবিষ্যতের রপ্তানি অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হবে ভুট্টা। আরো একটি আশার ব্যাপার হলো এই খাতে বৈশ্বিক চাহিদা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২৪ সালেই শুধু ভুট্টাজাত স্টার্চের বৈশ্বিক বাজার ছিল ৬১ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৮ সালের মধ্যে ৮০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। কর্ন সিরাপের বাজার ১৪ বিলিয়ন ডলার, কর্ন অয়েল ৯ বিলিয়নের বেশি।
এসব বাজারে ঢুকতে পারলে শুধু টাকা আয় হবে না, টেকসই শিল্প কাঠামোর ভিত গড়ে উঠবে। পাশাপাশি এই ফসলের পুষ্টিগুণ খাদ্য নিরাপত্তা এবং পুষ্টি উন্নয়নে অবদান রাখছে, যা জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও একটি অপ্রত্যাশিত সুবিধা।ভবিষ্যৎ কল্পনায় বাংলাদেশকে আত্মনির্ভর, রপ্তানিমুখী এবং প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে ভুট্টাকে কেবল ফসল নয় একটি কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে দেখতে হবে। এটি শুধুই কৃষকের বিষয় নয়, এটি অর্থনৈতিক নীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসার সময় এখনই। এক্ষেত্রে প্রয়োজন কিছু দূরদর্শী, সাহসী ও কার্যকর উদ্যোগ। ভুট্টা চাষে ভুট্টার উদ্ভাবনী বীজ ও প্রযুক্তির সমন্বয় করতে হবে।জলবায়ু-সহনশীল এবং উচ্চ ফলনশীল ভুট্টার জাতের বীজ প্রবর্তন এবং স্মার্ট সেচ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমেই চাষের সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কর্ন সিরাপ, স্টার্চ বা জৈব জ্বালানির মতো ভুট্টাভিত্তিক পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। এটি দেশীয় বাজারকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি রপ্তানির সম্ভাবনা বাড়াবে।জাতীয় ভুট্টা রূপান্তর পরিকল্পনা সংস্থা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি ভুট্টাভিত্তিক পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি জোন তৈরি করা যেতে পারে।
বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক দাম নিশ্চিত করে কৃষকের ন্যায্য দাম প্রদানের মাধ্যমে ভুট্টা চাষে অনুপ্রাণিত করতে হবে।ভুট্টা ভিত্তিক স্টার্টআপ ইনকিউবেশন সিস্টেম চালু করা যেতে পারে।যার মাধ্যমে ৫ বছরের জন্য কর মওকুফ, সহজ ঋণ, ও পুঁজি সরবরাহের মাধ্যমে তরুণ উদ্যোক্তাদের এই খাতে আকৃষ্ট করা যায়।আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে ‘Golden Corn of Bengal’ নামে বাংলাদেশি ভুট্টাকে আন্তর্জাতিক ফুড ফেয়ার, ট্রেড শো এবং বায়ার সম্মেলনে তুলে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে।যদি ভুট্টা উৎপাদনের বর্তমান গতিপথ অব্যাহত থাকে এবং বিজ্ঞানসম্মত, প্রযুক্তি নির্ভর ও পরিকল্পনা মাফিক কৌশলগুলো বাস্তবায়িত হয়, তবে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ভুট্টার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। আমদানি ব্যয় শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসবে এবং রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন উৎস সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয়, ভুট্টাভিত্তিক শিল্প গ্রামীণ ও শিল্প খাতে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, যা বেকারত্ব হ্রাসে অবদান রাখবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ক্রয়ক্ষমতা বাড়াবে। পাশাপাশি ভুট্টার পুষ্টিগুণ জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে অবদান রাখবে এবং জৈব জ্বালানি উৎপাদনের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির পথ প্রশস্ত হবে। বর্তমান সময়ে ভুট্টার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রের বিবেচনায় ভুট্টা শুধু একটি ফসল নয় বরং বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন প্রাণশক্তি, যা পোশাক রপ্তানির পরে কৃষি খাতে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে এবং হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘সাইলেন্ট রেভলিউশন।
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ইডেন মহিলা কলেজ