ভৌত অবকাঠামোতে প্রবেশগম্যতার অভাব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে
নাসরিন শওকত
নাঈমা নূর নাহার (ছদ্ম নাম), শারীরিক প্রতিবন্ধিতা জয়ী এক লড়াকু। তিন বোন, এক ভাইয়ের পরিবারে বড় সন্তান নাঈমা । ২০১৪ সালে বি কম এবং ২০২০ সালে এম বি এ ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি দেশের নারী অধিকারভিত্তিক একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় হিসাব শাখায় সহ-সমন্বয়কারী হিসেবে কর্মরত। ৬ মাস বয়সে পোলিও আক্রান্ত নাঈমার শিক্ষা ও কর্মজীবন কাটছে নির্মম বাস্তবতা ও বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। শিক্ষক ও সহপাঠীদের সহযোগিতায় তিনি স্কুল জীবন পার করেন বেশ নির্বিঘ্নেই। কিন্তু প্রতিবন্ধিতার বাস্তবতা তার কলেজ জীবনের প্রতিটি দিনকে যেন অভিশপ্ত করে তোলে। প্রতিদিন তিনতলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে ক্লাস করা, শিক্ষকদের অবহেলা আর সহপাঠীদের তার সাথে মিশতে, কথা বলতে বা বসতে না চাওয়ার উপেক্ষা দিন দিন তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতো। এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে নাঈমা দু’বছরের কলেজ সেশনে মাত্র দুই মাস ক্লাস করেন এবং এভাবে এইচএসি পাস করেন।
এরপর মিরপুর বাংলা কলেজে ভর্তি হন বি কম। তবে সেখানেও অসহযোগিতা ও উপেক্ষা তার পিছু নেয়। শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে এক ডিপার্টমেন্ট থেকে আরেক ডিপার্টমেন্ট যেতে না পারা এবং নিয়মিত ক্লাশ করতে না পারায় আশানুরূপ রেজাল্ট ছাড়াই বি কম পাস করেন নাঈমা। এরপর একই কলেজে এম বি এ -তে ভর্তি হন। তবে কলেজে যাতায়াতের সময় লোকাল বাস তাকে নিতে না চাওয়া এবং একা একা বাসে উঠতে না পারায় এম বিএ ক্লাসের দিনগুলো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে তার জন্য। বাসা থেকে যে টাকা যাতায়াত বাবদ পেতেন, তা রিকশা বা সি এন জি ভাড়ায় চলে যেত। ফলে না খেয়েই সারাদিন কাটাতে হতো নাঈমাকে। এভাবেই কোন রকমে এম বি এ শেষ করেন এবং একসময় সৌভাগ্যক্রমে চাকরিও পেয়ে যান তিনি । বর্তমানে নাঈমা যে অফিসে কাজ করছেন, সেটা তার বাসা থেকে বেশ দূরে। বেতনের অর্ধেক টাকা তার যাতায়াতের পেছনেই খরচ হয়ে যায়। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই পরিবার ছেড়ে তাকে অফিসের পাশে বাড়ি ভাড়া করে একা থাকতে হচ্ছে।
দেশে নাঈমার মতো এমন অনেক প্রতিবন্ধী রয়েছেন, যারা যাতায়াতের ক্ষেত্রে, যানবাহনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও কর্মসংস্থানে প্রবেশগম্যতার অভাবে জীবনবিমুখ হয়ে পড়ছেন, সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকেও পড়ছেন ঝরে।
বর্তমানে দেশে ৪৬ লাখ প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮০ শতাংশ। একাধিক পরিসংখ্যান বলছে, সমাজের পিছিয়ে থাকা এই জনগোষ্ঠীর মাত্র ২৭ দশমিক ২৯ শতাংশ কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত এবং দেশে মোট প্রতিবন্ধী শিশুর ৬০ শতাংশই আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে উঠে এসেছে যে, দেশে এখন পর্যন্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শনাক্তকরণ ও তার পরিসংখ্যান সঠিক ও সার্বিকভাবে হচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ-২০২১ এর তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে প্রতি এক হাজার জনের বিপরীতে ২৫ দশমিক ৫ জন কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার।
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের অভিমত, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মতো ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সার্বিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে ভৌত অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতার অভাব। তাদের পরামর্শ, এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নিশ্চিতে ভৌত পরিবেশে প্রবেশগম্যতা বাড়ানো জরুরি।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মানব বৈচিত্র্যের অংশ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধিতার ১২টি ধরন রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, বাক প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি প্রতিবন্ধিতা, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা, ডাউন সিনড্রোম প্রতিবন্ধিতা, এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা।
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মতে, ভৌত পরিবেশে প্রবেশগম্যতার অভাব প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বেশ কিছু বাধা বা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি দাঁড় করায়, যা তার নিন্মোক্ত নাগরিক অধিকার ও সুবিধা প্রাপ্তীর চ্যালেঞ্জকে বাড়িয়ে দেয়:
শিক্ষা গ্রহণে বাধা: স্কুলে যাওয়া, ক্লাসরুমে প্রবেশ করা, বা প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করতে না পারার কারণে অনেক প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
কর্মসংস্থানে প্রবেশে বাধা: কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা, কাজ করা, বা অফিসে যাতায়াতের জন্য উপযুক্ত বা প্রতিবন্ধীবান্ধব ব্যবস্থা না থাকায় অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি চাকরি পেতে বা কর্মজীবনে উন্নতি করতে পারেন না।
স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে বাধা: হাসপাতালে প্রবেশ করা, ডাক্তারের সাথে দেখা করা, বা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে না পারার কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হন।
সামাজিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণে বাধা: খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে না পারার কারণে তাদের সামাজিক জীবন সীমিত হয়ে যায়। মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব: প্রবেশগম্যতার অভাব তাদের আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীনতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে প্রতিবন্ধীব্যক্তিসহ সকল নাগরিকের সমঅধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা, মৌলিক মানবাধিকার ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছে। সংবিধানে ১৯ নং অনুচ্ছেদের ধারা ১-এ বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট থাকবে এবং ৩৬ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের অবাধ চলাচলের সুবিধার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়াও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে দেশে আইন, নীতি ও নানামুখী কর্মসূচি রয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঃযব জরমযঃং ড়ভ চবৎংড়হং রিঃয উরংধনরষরঃরবং (টঘঈজচউ)-এ স্বাক্ষর এবং অনুসমর্থন করে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন-২০১৩ নামে দুটি আইন পাস করেছে সরকার। এই সব আইন ও নীতির দিক থেকে অনেক উন্নত দেশের চেয়ে এগিয়েও রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ ভৌত পরিবেশে প্রবেশগম্য ব্যবস্থার স্বল্পতার কারণে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর বেশ বড় একটা অংশ চরম ঝুঁকির মধ্যে জীবন কাটায় এদেশে।
প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকারভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন উইমেন উইথ ডিজএ্যাবিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (ডাব্লিউডিডিএফ)। ২০০৭ সাল থেকে সংগঠনটি বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নারীদের বৈষম্যহীন জীবন নিশ্চিত ও তাদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। ডাব্লিউডিডিএফ নির্বাহি পরিচালক আশরাফুন নাহার মিস্টির মতে, শুধু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাই ভৌত অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতার উপকারভোগী বা সুবিধাভোগী। কিন্তু এই ভাবনা সঠিক নয়। মোট জনগোষ্ঠীর একটা অংশের প্রায় সবারই ভৌত অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী বিশেষ করে যাদের শারীরিক সীমাবদ্ধতা বেশি তাদের জন্য ভৌত অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতা খুব বেশি প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে যারা হুইল চেয়ার বা ক্র্যাচ ব্যবহার করেন বা অন্য কোন ধরনের এইড ব্যবহার করেন এবং শারীরিক প্রতিবন্ধিতা না থাকা বার্ধক্যে উপনিত বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্যও ভৌত অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতার খুবই প্রয়োজন।
প্রতিবন্ধী বিষয়ক গবেষকদের মতে, ভৌত অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতার অভাব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবনকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আশরাফুন নাহার মিস্টি মনে করেন, এই প্রতিকূল পরিবেশের কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ প্রবেশগম্যতার প্রয়োজন থাকা সমাজের অন্য সব মানুষের মনের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। তারা অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন, আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, জীবন থেকে পালাতে চান। মানসিক দুশ্চিন্তা, হতাশা এবং লাঞ্ছনা থেকে তাদের শারীরিক বিপর্যয় ঘটে। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তীর ক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতা না থাকায় তাদের অসুস্থতার তীব্রতা বাড়ে। এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে এবং তারা নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হন।
পিছিয়ে থাকা এবং সুবিধাবঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীর জন্য ভৌত পরিবেশসহ সকল স্থানে নির্বিঘ্নে ও বাধাহীন ভাবে অংশগ্রহণ ও বিচরনের মত প্রতিবন্ধীবান্ধব বা প্রবেশগম্য ব্যবস্থা কি সহজলভ্য? এ প্রসঙ্গে ডাব্লিউডিডিএফ-এর প্রধান আক্ষেপের সঙ্গে জানান, চারপাশে তাকালে আমরা দেখি যে, একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং একজন প্রতিবন্ধিতাহীন ব্যক্তি যখন বাসার বাইরে, কর্মস্থলে,শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিনোদনকেন্দ্রে অথবা কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে যাবেন, কিংবা জরুরি কাজে কোন অফিস -আদালতে যাবেন, তখনই তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে, বাড়ীর বাইরে প্রবেশগম্য পরিবেশ আছে কীনা? অর্থাৎ তারা যে ফুটপাত ধরে হাঁটবেন অথবা রাস্তা ক্রস করে ওপারে যাবেন, অথবা যে প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন, সেখানে কি নিজে নিজে সহজে- স্বচ্ছন্দে ও স্বাধীনভাবে চলে যেতে পারবেন, তারা? নাকি সেখানে যেতে তাদের অন্যের সহযোগিতা চাইতে হবে?
প্রতিবন্ধী সংগঠনটির এই নেতার মতে, প্রবেশগম্যতার এই অভাবের কারণেই আমাদের সমাজের প্রতিবন্ধী মানুষরা তাদের নিজেদের যে দক্ষতা ইচ্ছা এবং মনোবল আছে , সেগুলো প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হন। তবে আমি মনে করি, এই ব্যর্থতা প্রতিবন্ধী মানুষদের নয়, এই ব্যর্থতা আমাদের সমাজের। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে ১০ আসন বিশিষ্ট ছোট্ট একটি রেস্তোরাঁয়ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য প্রবেশগম্য ব্যবস্থা রাখা আছে। সেখানে কেউ চাইলেই হুইল চেয়ার নিয়ে, সাদা ছড়ি নিয়ে অথবা ভিন্ন ধরনের এইড নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে এবং বসার জন্য তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। । শুধু রেস্তোরাঁর ভেতরেই নয়, বাথরুম, ব্যাক ইয়ার্ড থেকে শুরু করে গাড়ির পার্কিং লট পর্যন্ত প্রতিটি স্থান প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রবেশগম্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশের বেশিরভাগ ভবন -স্থাপনা, বড় খাবার রেস্তোরাঁ বা বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এ ধরনের ব্যবস্থার স্বল্পতা লক্ষ্য করা যায়।
২০২২ সালে প্রকাশিত বিবিএস-এর লেবার ফোর্স সার্ভেতে দেখা যায়, দেশের প্রায় অর্ধ কোটি প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর মাত্র ২৭ দশমিক ২৯ শতাংশ কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত রয়েছে। অপর এক জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ ৬৬ দশমিক ২২ শতাংশ কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও জীবিকায়নের বাইরে রয়েছে। পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠানটির একই বছরের জরিপ দএনএসপিডি’ বলছে, দেশে মোট প্রতিবন্ধী শিশুর ৬০ শতাংশই আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে রয়েছে।
আশরাফুন নাহার মিস্টির মনে করেন, আমাদের দেশে বেশির ভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিজেকে শিক্ষা থেকে, স্বাস্থ্য থেকে, কর্মসংস্থান থেকে, বিনোদন থেকে, পরিবার গঠন থেকে এবং সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা বা বিরত রাখার একমাত্র কারণ হলো ভৌত অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতার অভাব। এ জনগোষ্ঠীর বেশ বড় একটা অংশ শিক্ষা থেকে পিছিয়ে আছে। শিক্ষা না থাকার কারণে তারা নিজেদের দক্ষতারও উন্নয়ন ঘটাতে পারে না। এর ফলে সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক যে কর্মস্থানগুলো রয়েছে, সেখানে তাদের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। এরপরও কোন একটি প্রতিষ্ঠান যদি তাদের জন্য উপযোগী প্রবেশগম্য ব্যবস্থা করতে না পারে, সেখানে চাকরির সুযোগ হলেও তারা ঝরে পরে। ফলে তাদের কর্মসংস্থান সুযোগও কমে যায়। এসমস্ত কারণে প্রতিবন্ধী মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় যা তার সার্বিক উন্নয়নের পথকে সংকুচিত করে তোলে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রবেশগম্যতার অভাব পূরণে করণীয় সম্পর্কে ডাব্লিউডিডিএফি-নেতা আশরাফুন নাহার বলেন, প্রথমত, আমরা ভৌত অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতা, তথ্য প্র্প্তাীর প্রবেশগম্যতা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে গণসচেতনতার প্রবশেগম্যতা সৃষ্টি করার জন্য ভৌত অবকাঠমোতে প্রতিবন্ধী মানুষদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সুবিধা আছে কিনা সেটা দেখবো। নকশা করার সময় বিষয়টি খেয়াল রাখা এবং বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের সুপারিশ এবং বরাদ্দ নিশ্চিত করব। দ্বিতীয়ত, গণসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজ বিদ্যমান নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করার লক্ষ্যে তথ্যের প্রবেশগম্যতা সৃষ্টি প্রয়োজন। এজন্য যেসকল মাধ্যমে আমরা সাধারণত ব্যবহার করি , তার পাশাপাশি অডিও ,ব্রেইল এবং ভিজ্যুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে আমরা তথ্যগুলো সম্প্রচার করব।
তৃতীয়ত , প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে মিডিয়ায় যে প্রচারণাগুলো যাবে সেগুলো অডিও, ভিডিও এবং রিডিং -এই তিনটি মাধ্যমে প্রচার হবে। চতুর্থত, প্রতিবন্ধীবান্ধব ন্যাশনাল বিল্ডিংকোড ২০২০- অনুসারে সার্বজনীন প্রবেশগম্য বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে বিল্ডিংগুলো নির্মাণ হচ্ছে কি না , তা মনিটরিং করব। এর আগে প্রতিবন্ধীবান্ধব ব্যবস্থা না রেখে যে বিল্ডিংগুলো নির্মাণ হয়েছে , সেগুলোতে প্রবেশগম্যবান্ধব ব্যবস্থা যুক্ত করতে উদ্যোগ নেব। এছাড়াও সরকারি যে ভবনগুলোতে এখনও প্রবেশগম্যতা নেই, সেগুলো যেন এই বাজেট মেয়াদকালেরই মধ্যেই অতি দ্রুত প্রতিবন্ধীবান্ধব করে তোলে। প্রতিবন্ধীবান্ধব প্রবেশগম্যতা বলতে আমরা সাধারণত একটি র্যাম্প থাকাকেই বুঝি, কিন্তু শুধু র্যাম্প থাকলেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সহজে চলাচল করতে পারে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চলাচলের রাস্তা ও ফুটপাতে র্যাম্পসহ লিফট, এবং হ্যান্ড্রেইল তৈরি ,পাবলিক ট্রান্সপোর্টে হুইলচেয়ার ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত স্থান তৈরি, ভবনগুলোতে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য প্রবেশগম্য টয়লেট এবং অন্যান্য সুবিধা তৈরি ,দৃষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ব্রেইল এবং অডিও সংকেত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, সমাজকাল ডট কম
বিআলো/ইমরান