করিডোর নিয়ে মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল আর্মেনিয়া
আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: আর্মেনিয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত একটি ভূমি করিডোরের পরিকল্পনা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, যার মাধ্যমে আজারবাইজানকে আর্মেনিয়ার দক্ষিণাঞ্চল সিউনিক প্রদেশ দিয়ে একটি করিডোর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হতো।
যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাবে উল্লেখ করেছিল, ১০০ বছরের জন্য ওই করিডোর লিজে দেওয়া হবে এবং একটি মার্কিন কোম্পানি এটি পরিচালনা করবে—ফলে আজারবাইজান মূল ভূখণ্ড থেকে তার বিচ্ছিন্ন নাখিজেভান অংশের সঙ্গে সরাসরি স্থলপথে যুক্ত হতে পারত।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের তুরস্কে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত থমাস ব্যারাক এক বিস্ময়কর প্রস্তাব দেন—সিউনিক প্রদেশের মধ্য দিয়ে আজারবাইজানকে ১০০ বছরের জন্য একটি করিডোর লিজে দেওয়া হোক। এর মাধ্যমে আজারবাইজান সরাসরি তাদের বিচ্ছিন্ন নাখিজেভান অংশে স্থলপথে পৌঁছাতে পারবে। রুটটি চালাবে একটি মার্কিন কোম্পানি। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এটি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। কিন্তু আর্মেনিয়ানদের চোখে এটি এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র।
শনিবার (২৬ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে দ্য আর্মেনিয়ান পোস্ট।
আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের প্রেসসচিব নাজেলি বাগদাসারিয়ান স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, আর্মেনিয়ার আইন অনুযায়ী বিদেশি নিয়ন্ত্রণে কোনও ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য জমি লিজ দেওয়া যায় না, শুধুমাত্র কৃষিকাজ বা পশুচারণের জন্য অনুমতি রয়েছে।
পার্লামেন্ট সদস্য আরমান ইয়েগোয়ান বলেন, ‘এই প্রস্তাবে আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব খর্ব হওয়ার ঝুঁকি দেখেছি।’
যদিও পাশিনিয়ান নিজে এই বিষয়ে কিছুটা অস্পষ্ট মন্তব্য করেছেন। ১৬ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এই ধরনের চুক্তিকে নির্মাণ অনুমতিপত্র হিসেবে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা সম্ভব, এবং চুক্তির মেয়াদ শেষে অবকাঠামোগুলো আর্মেনিয়ার মালিকানায় ফিরবে। এই মন্তব্য রাজনৈতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি করেছে—সরকার গোপনে আপসের দিকে এগোচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিরোধীরা জোর দিয়ে বলছে—এটা কোনো ‘শান্তি করিডোর’ নয়, এটা আজারবাইজান ও তুরস্কের পুরনো স্বপ্নের বাস্তবায়ন। তারা চায়, সিউনিক দিয়ে ইরান-আর্মেনিয়া সংযোগ ছিন্ন করে আর্মেনিয়াকে কোণঠাসা করতে। তাছাড়া আজারবাইজান তো বলেই দিয়েছে—এই রুটে আর্মেনিয়ার কাস্টমস বা নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। মানে, এটা হবে একরকম বৈদেশিক দখলদারির বৈধ রূপ।
এই প্রস্তাব যেন পুরনো ক্ষতের উপর নতুন আঘাত। ২০২০ সালে আর্তসাখ যুদ্ধে আর্মেনিয়া হারিয়েছে বিশাল এলাকা, ২০২৩ সালে নাগোর্নো-কারাবাখে হয়েছে জাতিগত নিধন। সেই প্রেক্ষাপটে সিউনিক যেন শেষ ভরসা। আর সেই ভরসাও যদি হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে আর্মেনিয়া কীভাবে টিকে থাকবে?
এর চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক হলো, আজারবাইজান এই করিডোর থেকে আর্মেনিয়ার কাস্টমস ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ বাদ দিতে চাইছে। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ বারবার বলেছেন, এই করিডোরে আর্মেনিয়ার কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। আর্মেনিয়ান পক্ষ এটিকে একটি ‘গোপন ভূখণ্ড দাবি’ বলে অভিহিত করেছে।
এই তথাকথিত ‘জাঙ্গেজুর করিডোর’ প্রকল্পকে আজারবাইজান দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখছে, যার মাধ্যমে আর্মেনিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করে নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে। এই প্রচেষ্টায় আজারবাইজানের পাশে আছে তার মিত্র তুরস্ক এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতাও যুক্ত হয়েছে বলে আশঙ্কা করছে অনেকেই।
২০২০ সালে আর্তসাখ যুদ্ধে ভয়াবহ পরাজয় এবং ২০২৩ সালে নাগোর্নো-কারাবাখ থেকে আর্মেনিয়ানদের জাতিগতভাবে বিতাড়নের পর আর্মেনিয়ার জাতীয় মনোবল ইতিমধ্যেই বিপর্যস্ত। এর মাঝে সিউনিক অঞ্চলকে বিদেশি নিয়ন্ত্রণে দেওয়া মানে আরও একটি গভীর ক্ষত তৈরি করা—এটি কেবল আঞ্চলিক নিরাপত্তা নয়, বরং ইরানের সঙ্গে আর্মেনিয়ার সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে।
সিউনিকবাসী এবং দেশটির অন্যান্য জনগণ বারবার স্পষ্ট করে বলেছেন, তারা কোনোভাবেই তাদের ভূখণ্ডের ওপর বিদেশি কিংবা আজারবাইজানি নিয়ন্ত্রণ মেনে নেবেন না। এই প্রস্তাব তাদের চোখে একটি একপাক্ষিক চাপ, যেখানে আর্মেনিয়াকে ছাড় দিতে বলা হচ্ছে, অথচ আজারবাইজান আগ্রাসন ও হুমকি অব্যাহত রেখেছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আর্মেনিয়ার জবাব হওয়া উচিত পরিষ্কার: কোনো করিডোর নয়, কোনো আপস নয়, এবং নিজের মাটির ওপর সার্বভৌম কর্তৃত্বে কোনো ছাড় নয়—বিশেষ করে এমন একটি দেশের প্রতি নয়, যে আক্রমণ, সহিংসতা ও মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনে অভ্যস্ত।
বিআলো/শিলি