নিরাপদ আশ্রয়ের এক নতুন ঠিকানা, অসহায় মানুষের পাশে মাস্তুল ফাউন্ডেশন
মাস্তুল ফাউন্ডেশনের ‘শেল্টারহোম কমপ্লেক্স’ নির্মাণে মহৎ যাত্রা
রতন বালো: নক্ষত্রের মতো আলো ছড়ানো এক জনহিতকর মানবিক উদ্যোগ নিয়েছে মাস্তুল ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনটির নিরাপদ আশ্রয়ের এই নতুন প্লাটফর্মটি জনকল্যাণমূলক কাজে নানাবিধ উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। সমাজে অসহায় সুবিধা বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ১০ তলা বিশিষ্ট মাস্তুল শেল্টারহোম কমপ্লেক্স নির্মাণের এক গণমুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেখানে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, স্কুল, ট্রেনিং সেন্টার ও চিকিৎসা কেন্দ্র নিয়ে গড়ে তোলা হবে অসহায় মানুষের নির্ভরতার আস্তানাটি। ফাউন্ডেশনটির নিজস্ব জায়গায় রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর পাশে হাজারীবাগের বারইখালি এলাকায় এই শেল্টারহোমটি আগামী সেপ্টেম্বর থেকে নির্মাণ কাজ শুরু হবে এমনটিই জানালেন কর্তৃপক্ষ। যা শেষ করতে সময় লাগবে সবমিলিয়ে আড়াই থেকে তিন বছর।
বিষয়টি নিয়ে মাস্তুল ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, মানুষের মৌলিক চাহিদার ভিতরে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসার নিশ্চয়তার কথা বলা হলেও আমাদের দেশে সেই সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। দেশে এমন অনেক শিশু রয়েছে যারা এতিম তাদের খাওয়া পরার কোন নিশ্চয়তা নেই, শিক্ষা তাদের কাছে বিলাসিতা। আবার আমাদের সমাজে অনেক অসহায় বৃদ্ধ ও দরিদ্র মানুষের নিরাপদ আশ্রয় তথা বাসস্থানের সংকট রয়েছে। এসব মানুষগুলো শিক্ষা ও চিকিৎসার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
এ সকল বঞ্চিত মানুষের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে মাস্তুল ফাউন্ডেশন। সংগঠনটি শতাধিক শিশু ও বৃদ্ধকে আশ্রয় দান করেছে। সেই সঙ্গে শুরু থেকেই শিক্ষা, খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে। তবে বর্তমান শেল্টারহোমের সীমিত জায়গা ও পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায় সব চাহিদা পূরণে একান্ত ইচ্ছে থাকা সত্বেও যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মাস্তুল ফাউন্ডেশন একটি মহতী উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। যা বৃহৎ ও আধুনিক মাস্তুল শেল্টারহোম কমপ্লেক্স নির্মাণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। পরিকল্পিত শেল্টারহোম কমপ্লেক্সের ১ম তলায় থাকবে অডিটোরিয়াম। যেখানে বড় মিটিং ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে। এছাড়া রামাদানে সবার জন্য ইফতার কর্মসূচি, বিনামূল্যে লাশ গোসল ও কাফন সেবা ও দরিদ্রদের বিনামূল্যে বিবাহসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির মানউন্নয়নে ব্যপক পদক্ষেপ নেবার পরিকল্পনা রয়েছে। আর ২য় তলায় থাকবে পুরুষ ও নারীদের জন্য সালাত (নামাজ) আদায়ের ব্যবস্থা, সিনিয়রদের কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা, নিয়মিত ইসলামী প্রোগ্রাম, ঈদের সালাতের ব্যবস্থা ও জানাজার সালাত আদায়ের সু বন্দোবস্ত থাকবে।

মাস্তুল স্কুল ট্রেইনিং সেন্টার:
পরিকল্পনার মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় থাকবে উন্নত পরিবেশে শিক্ষা ব্যবস্থা। যুগোপযোগী বিভিন্ন কোর্স, দরিদ্রদের বিনামূল্যে কর্মক্ষম প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা, নারীদের স্বাবলম্বীকরণে বিভিন্ন কোর্স, উন্নত প্র্যাক্টিকেল ল্যাব ও লাইব্রেরি এবং বেকার যুবক-যুবতীদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা থাকবে।
মাস্তুল মাদ্রাসা:
৫ম ও ৬ষ্ঠ তলায় থাকবে অসহায় দরিদ্রদের উন্নত পরিবেশে শিক্ষা ব্যবস্থা করা। এছাড়া দক্ষ আলেমগণ দ্বারা পরিচালিত, দরিদ্রদের হাফিজ হবার স্বপ্ন পূরণ, হাফেজি শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ করে তোলা হবে-যার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হবার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
মাস্তুল এতিমখানা:
সপ্তম ও অষ্টম তলায় থাকবে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা ও থাকার জায়গা, পুষ্টিকর খাদ্য ও খেলাধুলার ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় বস্ত্র ও শিক্ষা সামগ্রী ও ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা এবং বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধদের কাছ থেকে পিতা-মাতার ভালোবাসা নিশ্চিত করণ।
মাস্তুল বৃদ্ধাশ্রম ও মেডিক্যাল কর্নার:
নবম ও দশম তলায় থাকবে আরামদায়ক থাকার জায়গা, পুষ্টিকর খাদ্য ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা। এছাড়া প্রয়োজনীয় বস্ত্র, অন্যান্য সামগ্রী ও ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা, এতিম বাচ্চাগুলোর সঙ্গে সময় কাটিয়ে নিজের একাকীত্ব থেকে মুক্তি ও পরিচ্ছন্ন, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ, উন্নত পরিবেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা, দক্ষ ডাক্তার ও নার্স এবং বিনামূল্যে বিভিন্ন হেলথ ক্যাম্পেইন ও বিনামূল্যে চেকাপ করার ব্যবস্থা থাকবে।
শেল্টারহোম কমপ্লেক্স এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা :
মাস্তুল ইসলামিক শেল্টারহোম কমপ্লেক্স হবে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক মানবিক কেন্দ্র, যেখানে এতিম শিশু ও বৃদ্ধরা নিরাপদে বসবাসের পাশাপাশি শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পাবে। এখানে থাকবে আধুনিক স্কুল ও মাদ্রাসা, এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, স্কিল ট্রেইনিং সেন্টার, লাইব্রেরি, অডিটোরিয়াম, মসজিদ এবং মেডিক্যাল সেন্টার। এটি কেবল একটি আশ্রয়ের জায়গা নয়, বরং এমন একটি পরিবেশ যেখানে শিশুদের স্বপ্ন পূর্ণতা পাবে এবং বৃদ্ধদের শেষ সময় কাটবে ভালোবাসা ও মর্যাদার সঙ্গে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য :
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো অসহায়দের জন্য নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা, শিশুদের শিক্ষিত ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা এবং বৃদ্ধদের জন্য যত্নশীল একটি আবাসন তৈরি করা। পাশাপাশি, স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে সকল বাসিন্দার সুস্থতা বজায় রাখা এবং একটি মডেল শেল্টার তৈরি করা যা সারা দেশের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
মাস্তুল ফাউন্ডেশন এর কার্যাবলী :
মাস্তুল ফাউন্ডেশন সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত একটি স্বনামধন্য ও সেবামূলক জাতীয় প্রতিষ্ঠান। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মাস্তুল ফাউন্ডেশন দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ও শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে নিরলস ভাবে কাজ করে আসছে।
মানবিক কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : করোনা মহামারির সময় দাফন সেবা প্রদান, ২০২২ ও ২০২৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে জরুরি ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ এবং ২০২৩ সালের তুরস্কের ভূমিকম্পে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তা প্রদান।
এছাড়া মাস্তুল ফাউন্ডেশনের অন্যতম সফল প্রকল্প ‘যাকাত স্বাবলম্বী’ এর মাধ্যমে অসংখ্য অসহায় ব্যক্তি ও যুব সমাজের জন্য স্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, যা তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলছে। রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন বিনামূল্যে অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিতদের একবেলার খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়াও রাজধানীর হাজারীবাগ বারইখালি এলাকায় নিজস্ব মাদ্রাসা, সেল্টারহোম, এতিমখানা ও মেহমানখানা রয়েছে।
এ বিষয়ে মাস্তুল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক কাজী রিয়াজ রহমান-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মাস্তুল ফাউন্ডেশনের শুরু থেকেই স্বপ্ন ছিল একটি সমাজ যেখানে কোনো শিশু অনাথত্বের কষ্টে কাঁদবে না, কোনোবৃদ্ধ একাকীত্বে দিন শেষ করবে না। আজ আমরা যেখানে শেল্টারহোম পরিচালনা করছি, তা সকলের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়। তাই আমরা শুরু করছি একটি বৃহৎ ও আধুনিক শেল্টারহোম কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ। এখানে থাকবে শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, চিকিৎসা ও নিরাপদ আশ্রয়ের সমস্ত সুবিধা। এই প্রকল্প শুধুমাত্র একটি ভবন নয়, এটি হবে অসহায় মানুষের জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ আবাস্থল। আমরা চাই, এই স্বপ্ন পূরণে সবাই এগিয়ে আসুক। কারণ একটি ইট, একটিশেয়ার ও অল্প অনুদানেও আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলতে পারি হাজারো জীবনের নিরাপদ ভবিষ্যৎ।
তিনি আরো বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আইন অনুসারে মাস্তুল ফাউন্ডেশনকে প্রদত্ত যেকোনো পরিমাণ যাকাত, দান বা সাদাকা আয়করমুক্ত। অর্থাৎ মাস্তুল ফাউন্ডেশনে দান করা অর্থদাতাদের জন্য আয়কর রেয়াত হিসেবে গণ্যহবে বলে তিনি জানান। তাইতো মাস্তুল ফাউন্ডেশন কবি কামিনী রায়ের সেই কবিতাকে শিরোধার্য করেছে।
‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’
এভাবেই মানবিকতার উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে মাস্তুল ফাউন্ডেশনের সব কার্যক্রম।
বিআলো/তুরাগ