জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রায়েরবাগ এলাকা রণক্ষেত্র: আন্দোলনের নামে রক্ত আর মৃত্যুর মিছিল
৩ দিনের সংঘর্ষে নিহত ২২, আহত ৭০
📍 রায়েরবাগে রাষ্ট্রের রক্তাক্ত প্রতিশোধ
📍 শুক্রবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ভয়াবহ সংঘর্ষ
📍 হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর অভিযোগ
📍 ড্রোন দিয়ে অভিযানে পথচারীরাও রেহাই পায়নি
📍 প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো নেই নিহতের তালিকা
ইবনে ফরহাদ তুরাগঃ রায়েরবাগ একটি শান্ত আবাসিক এলাকা। ছেলেমেয়েরা মাঠে খেলে, বৃদ্ধেরা বিকেলে হাঁটেন, সন্ধ্যায় মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসে আযান। সেই রায়েরবাগ, জনতাবাগ, মেরাজনগর ও মুজাহিদনগর আজ মৃত্যুপুরী। এখানে গুলির শব্দে কেঁপে উঠেছে প্রতিটি ভবনের দেয়াল। চার বছরের শিশুর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বারান্দার বেলকনি। পুলিশ হত্যা করে ফ্লাইওভারে ঝুলিয়ে রাখা আর কোটাবিরোধী আন্দোলনের মুখোমুখি অবস্থান—সব মিলিয়ে একটি সামরিক শাসনের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে রাজধানীর কদমতলী থানাধীন রায়েরবাগ অঞ্চলে।
এই শান্তিপূর্ণ আবাসিক এলাকাটি গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) সকাল থেকে ২২ জুলাই (রবিবার) রাত পর্যন্ত ৩ দিনে সৃষ্ট সহিংসতায় পরিণত হয়েছে ভয়ঙ্কর মৃত্যুপুরীতে। পুলিশের বেপরোয়া গুলি, ছাত্রলীগ-যুবলীগের অস্ত্রের শোডাউন এবং কোটাবিরোধীদের প্রতিরোধ—এই ত্রিমুখী সংঘর্ষে অন্তত ২২ জন নিহত ও ৭০-এর অধিক আহত হয়েছেন । যাদের মধ্যে অন্তত ৪০ জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বলে এলাকাবাসীর সূত্রে জানা গেছে। নিহতদের মধ্যে শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ, আন্দোলনকারী, পুলিশ সদস্য এবং স্থানীয় বাসিন্দা রয়েছেন।
আজ ২৫ জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত সরেজমিনে ধারনকৃত তথ্যমতে এলাকায় এখনো কারফিউ, আতঙ্ক এবং ধ্বংসস্তূপ।
পুরো ঘটনা শুরু হয় বৃহস্পতিবার রাত থেকে আন্দোলনকারীদের রায়েরবাগ এলাকায় অবস্থান নেওয়া এবং শুক্রবার সকাল থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে।
আন্দোলনের সূচনা ও উত্তেজনা
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) রাত থেকেই রায়েরবাগ বিশ্বরোডে আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কার দাবিতে অবস্থান নিতে শুরু করে। এলাকায় পুলিশি টহলও বাড়ে। শুক্রবার সকালে থানায় হামলার আশঙ্কায় পুলিশ প্রথম গুলি চালায় – এখানেই সূত্রপাত।
শুক্রবার: প্রথম দিনেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ
প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকালে রায়েরবাগ তিতাশ গ্যাস অফিস থেকে ষ্ট্যান্ড পর্যন্ত কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর স্নাইপার পিস্তল দিয়ে পুলিশ গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হন দুইজন। এরপর উত্তেজিত জনতা পুলিশের ওপর পাল্টা হামলা চালালে পুলিশের একজন সদস্য গুরুতর আহত হয়।
একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষায়, “পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি করে দৌড় দেয়, পরিপ্রেক্ষিতে ওরাও পাল্টা জটলা করে হামলা চালিয়ে পুলিশ দুইটিকে ধরে ফেলে এবং গনপিটুনি দেয়।”
সংঘর্ষের সূত্রপাত: “গোলাগুলির শুরু থানার সামনে”
এরপর পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একই সকালে আন্দোলনকারীরা থানার দিকে ধেয়ে গেলে পুলিশ গুলি চালায়, আহত হন সিএনজি ও অটোচালকরা—যাদের কেউই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এ সময় নিহত হন দুজন চালক।
রক্তাক্ত শুক্রবার সেই ভয়ানক দিন : শিশু ও পথচারী নিহত
দিনটি ছিলো ১৯ জুলাই (শুক্রবার) বিকেল ৩টা। ঐদিন জুমার নামাজের পর কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা রায়েরবাগ বিশ্বরোড থেকে তাদের অবস্থান সরিয়ে কদমতলী থানা ঘেরাও করতে আসে। এর পরিপেক্ষিতে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও এলাকাবাসীর বাধার সম্মুখীন হয়ে আন্দোলনকারীরা মুজাহিদনগর ও মেরাজনগর আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে। যার ফলে এলাকাবাসীর জন্য নেমে আসে বিরাট বিপর্যয়। এ সময় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রায়েরবাগ আবাসিক এলাকা।
এক পর্যায়ে কোটাবিরোধীদের নৈরাজ্য ঠেকাতে মাঠে নামেন যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। শুরু হয় দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ। প্রায় ২ ঘণ্টা সংঘর্ষের পর এ সময় আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেয় মেরাজনগর বি-ব্লক শান্তি নিবাস ভবনের নিচে।
তখন সময় বিকাল ৪টা। সেদিন মেরাজনগর বি-ব্লক আবাসিক এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের ব্যপক সংঘর্ষ চলছিল। এসময় ইট পাটকেল নিক্ষেপ আর গোলাগুলির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় শিশু আহাদের। নিঃস্পাপ শিশুটি ছুটে আসে বারান্দায়। সাথে আসেন তার মা-বাবাও। এক পাশে বাবা, আরেক পাশে মা, মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট আহাদ। সবাই নিচের দিকে তাকিয়ে।

শুক্রবার মেরাজনগর বি-ব্লক এর ‘শান্তি নিবাস-২’ নামে একটি ভবনের ৮ তলায় মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটে। একই ভবনের নিচে ৫৫ বছর বয়সী এক পথচারীকেও কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে হামলাকারীরা। বিকেলে আহত ও নিহতদের ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয় বলে জানা যায়।
পূর্ব শত্রুতার সুযোগে খুন মাসুদ? নেপথ্যে কারা!
একই সময়ে শুক্রবার বিকেল ৫ টায় যুবলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে আরেক দফা সংঘর্ষ চলাকালীন এই হানাহানির মধ্যে ‘পূর্ব শত্রুতা’কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে খুন করা হয় মাসুদ (৪২) নামে এক স্থানীয় বাসিন্দাকে। আসরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় তাকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকে রাজনৈতিক সংঘর্ষের ছত্রছায়ায় ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা হিসেবেই দেখছেন স্থানীয়রা।
এলাকাবাসী জানান, সংঘর্ষের সময় মাসুদের মাথায় গুলি করার পরও ক্ষান্ত হয়নি দুর্বৃত্তরা। দ্বিতীয় ধাপে তারা আবার কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এ সময় আশিক (১৯) নামে একজনকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।
মোবাইল ফোনে গোপনে ধারণকৃত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ২ যুবক শাস্তি নিবাস ভবনের নিচ থেকে ভবনের আশপাশে ও শাহী মসজিদের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে। এর মধ্যে ১ যুবক মুখে লাল রুমাল বেঁধে সামনে থেকে গুলি করছে। এ সময় তাদেরকে গুলি চালাতে নির্দেশনা দিচ্ছে কয়েকজন হেলমেটধারী, অনেকের হাতে ছিলো দেশীয় অস্ত্র।
বোনের বাসায় বেড়াতে এসে প্রাণ যায় যুবকের
একই দিনে ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর রায়েরবাগে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় কদমতলী থানার নিকটে মদিনাবাগ আবাসিক এলাকায় পুলিশের গুলিতে প্রান হারান শাটার মিস্ত্রি হৃদয় (২৬)।
হৃদয় বোন সুরমা বলেন, আমরা সন্ধ্যা ৭:৩০ এ খবর পাই, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এলাকার কিছু লোকজন তাকে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যায়, সেখান থেকেই ফোন আসে হৃদয়ের লাশ নিয়ে আসতে।
হৃদয়ের স্ত্রী জানান, “কাটা ছেড়ার ভয়ে মামলা করিনি”। লাশ মেডিকেল থেকে নিয়ে এসেছি। এরপর শনিবার (২০ জুলাই) সকালে মাতুয়াইল কবরস্থানে তাকে দাফন করি। নিহত হৃদয়ের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা, দাউদকান্দি।
সরেজমিন ঘুরে ও এলাকাবাসীর তথ্য মতে শুক্রবারেই রায়েরবাগ এলাকা থেকে অন্তত ৪০ জন গুলিবিদ্ধ ও গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
একইদিনে রায়েরবাগ ফুটওভারব্রিজের পাশে গুলিতে নিহত হন জাকির
যাত্রাবাড়ী থানার এজাহারে বলা হয়, গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) যাত্রাবাড়ী থানার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রায়েরবাগ ফুটওভারব্রিজের পাশে পাকা রাস্তার ওপর কোটাবিরোধী আন্দোলনের আড়ালে সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে জাকির হোসেন (২৯) গুরুতর জখম হন। আশপাশের লোকজন উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন। ২৫ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জাকির।
প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের নেশা: যা পরিনতি হলো পুলিশের
শুক্রবার সন্ধ্যায় মুজাহিদনগর মসজিদের মাইক থেকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হলে মুয়াজ্জিমকে পুলিশের সোর্স কতৃক হামলার শিকার হতে হয়। পরে এলাকাবাসীর রোষানলে পরে গেলে পালিয়ে যাওয়ার সময় এই পুলিশ সোর্স গণপিটুনিতে নিহত হয়।
একই সন্ধ্যায় থানার মাত্র ২০০ গজ দূরে পুলিশের গুলিতে তামিম নামে এক কিশোর নিহত হয়, যার একটি ভিডিও আসে সে সময় দৈনিক বাংলাদেশের আলো’র হাতে। রাত সাড়ে ১০টায় পুলিশের জন্য খাবার বহনকারী সিএনজিতে এলাকাবাসীর হামলায় খাবার ছিনতাই, গাড়ি ভাঙচুর এবং দুই আরোহীর আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
একই রাতে ১৯ জুলাই (শুক্রবার) সাড়ে ১১টায় রায়েরবাগ বিশ্বরোড দিয়ে যাওয়ার সময় এক মোটরসাইকেল আরোহীকে তাড়া করে আন্দোলনকারীদের আড়ালে থাকা দূর্বিত্তরা। তাদের তাড়া খেয়ে মোটরসাইকেল আরোহী রাস্তার পাশে পরে গেলে সাথে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করে পুলিশের পোশাক ও আইডি কার্ড দেখতে পায়। তখন তারা পুলিশ পুলিশ বলে চিৎকার করে। তাদের চিৎকারে আশপাশের অনেকে সেখানে জড়ো হয়। এ সময় তাদের হাতে থাকা হকিস্টিক, বাঁশ, লাঠি ইত্যাদি দিয়ে ওই পুলিশ সদস্যকে মারতে থাকে। ঘটনাস্থলেই পুলিশ সদস্যের মৃত্যু ঘটে। তার মৃতদেহ নিয়ে তারা উল্লাসে মেতে উঠে। পুলিশের মোটরসাইকেলটিতেও তারা অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়। পুলিশের এই সদস্য নায়েক গিয়াস উদ্দিন (৫৮) ঢাকা মহানগর পুলিশের নায়েক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
পরের দিন ২০ জুলাই (শনিবার) সকালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। শনিবার সকালে ডিউটিতে যাওয়ার সময় এই পুলিশ সদস্যকে গতিরোধ করে পিটিয়ে হত্যা করে দূর্বিত্তরা। এরপর সেই লাশ নিয়ে ফুটওভার ব্রিজে ঝুলিয়ে রেখে আনন্দ উল্লাশে মেতে উঠে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ওই এলাকায় মোটরসাইকেলে করে সাদা পোশাকে একজন ব্যক্তিকে আসতে দেখে হামলাকারীরা ধাওয়া করে, তাকে ধরে ফেলে এবং পুলিশ সদস্য বুঝতে পেরে তাদের হাতে থাকা হকিস্টিক, বাঁশ, লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে এবং ঘটনাস্থলেই ওই পুলিশ সদস্যের মৃত্যু নিশ্চিত করে। তার মোটরসাইকেলটিও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের এই সদস্য মোহাম্মদ মুক্তাদির (৫০) টুরিস্ট পুলিশের এএসআই ছিলেন।
সেদিনের এই দৃশ্য চোখে দেখার লোমহর্ষক বর্ননা দেন রায়েরবাগের একজন পরিবহন শ্রমিক। মিন্টু বলেন, এই পুলিশটিকে প্রথমে প্রচন্ড ভাবে মারা হয়। পরে হাত পা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ফারা হয়, তখন পুলিশ সদস্য কষ্ট সহ্য না করতে পেরে বলে আমাকে মেরে ফেল। কিন্তু পাষণ্ডরা তাকে উল্টো করে ঝুলিয়ে নিচে টায়ার জ্বালিয়ে আগুন দিয়ে দেয়। ব্যাগে পুলিশের ড্রেস পেয়েই ওনাকে হত্যা করা হয়।
— প্রতিবাদস্বরূপ একটি লাশ ফুট ওভারব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যা দমনপীড়নের প্রতীক হয়ে ওঠে।
স্থানীয়রা জানান, সেদিন ফুট-ওভারব্রিজে পুলিশের ঝুলন্ত লাশ দেখার জন্য ব্রিজের চারপাশেই প্রচুর ছাত্র-জনতা ছিলো। প্রায় ৩ ঘন্টা পর পুলিশ সেই লাশ উদ্ধার করে। এ সময় আগে পুলিশ গুলি করতে করতে রায়েরবাগ ব্রিজের দিকে অগ্রসর হয়। একই সময় আকাশে হেলিকপ্টার মহড়া দিতে দেখা যায়। একসময় ফায়ার করতে করতে ঝুলন্ত লাশটির সামনে যায় পুলিশ। আবার লাশটিকে নিচে নামিয়ে আবার ফায়ার করতে থাকে চারদিকেই। তখন প্রায় ১২:৪০, এ সময় সেখানে প্রচুর লোক গুলিবিদ্ধ হয়। পাখির মতো করে এইদিন মানুষ হত্যা করা হয়। এলাকার অনেক মানুষ এখনো নিখোঁজ।
দৈনিক বাংলাদেশের আলোর কাছে আসা গোপন ক্যামেরায় ধারনকৃত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সেদিন ২১ জুলাই (শনিবার) সকালে পুলিশের ৮ টি সাজোয়াট্যাংক ও ৬ টি র্যাব এর কাভার ভেন, ১২ টি কালো ও ৪ টি সাদা প্রাইভেটকার ও বাইক সহ প্রায় শতাধিক পুলিশ ফোর্স শনিআখড়া থেকে রায়েরবাগ ফুট ওভারব্রিজ যাওয়ার পথে এট্যাকিং পজিশনে অবস্থান করছে। এ সময় সড়কের উপর দিয়ে র্যাব এর একটি হেলিকপ্টার রায়েরবাগ ফুট ওভার ব্রিজের দিকে উড়ে যেতে দেখা যায়।
পুলিশের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া অভিযান
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে শনিবার রাত থেকে পুলিশ রায়েরবাগ ও আশপাশের এলাকাগুলোতে ফাঁকা গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে আগায়। রাত্রি ২টা পর্যন্ত বিশ্বরোড সংলগ্ন ৭টি এলাকাতে পুলিশের অভিযান চলে।
পুলিশের গুলিতে জিসান ও নাসিরের মৃত্যু
শনিবার (২০ জুলাই) দুপুরে রায়েরবাগে বসবাসকারী জিসান নামে একজন পানির ফিল্টার ব্যবসায়ীর নিহতের ঘটনা ঘটে। জিসান আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন এবং পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সেদিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে যে কোনো সময় যাত্রাবাড়ী থানার রায়েরবাগ ফুটওভার ব্রিজের পাশে গুলিতে জিসান ও নাসির নিহত হন বলে জানায় নিহতের পরিবার।
রায়েরবাগের ফুটওভার ব্রিজের ঢালে গুলিতে মারা যান সাজিদুর রহমান
২১ জুলাই (শনিবার) দুপুরে রায়েরবাগ ফুটওভার ব্রিজের নিচে আন্দোলনের সময় গুলিতে সাজিদুর রহমান (২০) গুরুতর আহত হন। ২৪ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
তিন দিন ধরে চলা সংঘর্ষের পর মাইনউদ্দিনের মৃত্যু
২১ জুলাই পর্যন্ত তিন দিন ধরে চলা সংঘর্ষে মাইনউদ্দিন নামে পঁচিশ বছর বয়সী এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় ২৮ জুলাই যাত্রাবাড়ী থাানার এসআই মনিউজ্জামান বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। নিহতের পরিবার জানায়, ২১ জুলাই রায়েরবাগ ফুটওভারব্রিজের নিচে গুলিকে মাইন উদ্দিন গুরুতর জখম হন। ২৬ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
২২ শে জুলাই (রবিবার) দুপুরে রায়েরবাগ খানকা শরীফ রোডে গুলিতে নিহত হন অজ্ঞাত আরো দুইজন, স্থানীয়দের দাবি—হেলিকপ্টার থেকেও গুলি ছোড়া হয়। সন্ধ্যার পর পুলিশের ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে হুলিয়া চালানো হয়, পথচারী ও দোকানদারদের লক্ষ্য করে গুলিও চালানো হয়। রাতে মুজাহিদনগর জিরো পয়েন্টে আরেকজন আহত হয় পুলিশের গুলিতে।
চিকিৎসা ও কারফিউ
ঘটনার ৩ দিনেই মোট আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০-এর বেশি। অন্তত ৪০ জন গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। এলাকাবাসী জানায়, এদের অনেকে সাধারণ মানুষ, যারা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে, ২৩ জুলাই সোমবার থেকে শুরু হয় কারফিউ। দুপুর ২টা থেকে ৭টা পর্যন্ত সীমিত চলাচলের অনুমতি ছাড়া বাকিটা সময় পুরো থানা এলাকা অবরুদ্ধ।
৫ আগষ্ট যাত্রাবাড়ীতে রায়েরবাগ প্রতিবন্ধি স্কুলের মেধাবী ছাত্র রাকিব এর মৃত্যু
সর্বশেষ এই রাকিব হত্যাকাণ্ড সেদিন ঘটেছিল যেদিন শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে টানা ৩৬ দিন ধরে চলা বিক্ষোভের মুখে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন ভারতে পালিয়ে যান। ৫ই আগস্ট দুপুরে থানার সামনে পুলিশের নির্বিচারে গুলিতে নিহত হন রাকিব। মৃত্যুর সময় রাকিবের হাতে বাংলাদেশের পতাকা ছিলো বলে জানায় নিহতের বড় ভাই আমিন।
আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বাহিনীর একজন মূখ্য পত্র ঘটনা স্বীকার করেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের সময়ে এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। এখানে তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য অতিরিক্ত বল প্রয়োগে লিপ্ত হয়েছিলেন। এবং আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে অপেশাদার আচরণ করেছিলেন।
তথ্য অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে, জুলাই আন্দোলনে মাত্র ৯৩ জন পুলিশ সদস্য ছাত্রজনতার উপর অন্তত ৫২৩৫ রাউন্ড প্রাণঘাতী বুলেট ছোড়ে! ঢাকার ৩টি স্পট যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর ও উত্তরায় ১৮ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত এই গুলি ছোড়া হয়। ব্যবহার করা হয় মারণাস্ত্র এসএমজি, এলএমজি, চায়না রাইফেল, বিডি-৮ অ্যাসল্ড রাইফেল, টরাস ও সিজে পিস্তুত। আন্দোলন দমাতে গুলি ছোড়া হয় অচেনা অনেক প্রানঘাতী অস্ত্র থেকেও। এসব গুলিতে কি হতে পারে? শতভাগ মৃত্যু নাকি অঙ্গহানি?
এসব তথ্যের আলোকে, জুলাই-আগষ্ট ২০২৪ গনঅভ্যুত্থানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের শেষ সময়ে হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলো কিভাবে ঘটেছিল সেটি বের করার জন্য একাধিক ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য গ্রহণ এবং সেগুলো বিশ্লেষণের পাশাপাশি সরেজমিন কয়েকবার রায়েরবাগ, সাইনবোর্ড, শনিআখড়া, যাত্রাবাড়ী ও তার আশেরপাশের এলাকার বিভিন্ন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তথ্যকে সংবাদে রূপান্তরিত করে তা বিস্তারিত তুলে আনা হয়েছে দৈনিক বাংলাদেশের আলো’র প্রতিবেদনে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, জাতিসংঘের প্রতিবেদন ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে নানান খবর প্রকাশিত হলেও নির্বিচারে হত্যার ঘটনাটি কিভাবে শুরু ও শেষ হয়েছিল? তাতে কত মানুষ হতাহত হয়েছিলেন সে সম্পর্কে দৈনিক বাংলাদেশ আলোর অনুসন্ধানে এমন কিছু তথ্য ও বিবরণ উঠে এসেছে। যা আগে সেভাবে সামনে আসেনি।
জনমনে এখনো যেসব প্রশ্ন রয়ে গেছে?
- কেন জনবহুল আবাসিক এলাকায় টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হলো?
- পুলিশ হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত কে দিল?
- সংঘর্ষে নিহত শিশু ও সাধারণ মানুষের দায় কার?
- মাসুদের মতো ব্যক্তিগত খুন কেন এই পরিস্থিতির ছত্রছায়ায় চাপা পড়ে যাচ্ছে?
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আবাসিক এলাকা রায়েরবাগের নামে লেখা হলো এক রক্তাক্ত অধ্যায়। ইতিহাস কি একে গণপ্রতিরোধ বলবে, নাকি রাষ্ট্রীয় দমননীতির কালো ছায়া? এ ঘটনায় পুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, আন্দোলনকারীরা পরস্পরের উপর হামলার অভিযোগ করেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংঘর্ষে নিহত–আহতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো স্পষ্ট বিবৃতি পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, রায়েরবাগ আবাসিক এলাকায় কোটা আন্দোলনকে ঘিরে ত্রিমুখী সংঘর্ষে এই তিন দিনে যা ঘটেছে , তা শুধু সংঘর্ষ নয়—এ যেন একটি সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নগ্ন সহিংসতা। যারা কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেমেছিল, তারা এখন আতঙ্কিত, পলাতক কিংবা নিহত। আর সাধারণ জনগণ—তারা শুধু গুলি আর দমননীতির শিকার।
updated…
বিআলো/নিউজ