বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নাগরিক অধিকার ভোগের বাস্তবতা: নাসরিন শওকত
লুবানা নাইমা হক, দৃষ্টিজয়ী এক প্রতিবন্ধী। ২০১৫ সালে শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি থেকে সঙ্গীতে অনার্স এবং ২০১৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইউডা) থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ওপরে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি গান করতেন ছোটবেলা থেকেই। রেডিও ও টেলিভিশনের নিবন্ধিত শিল্পী তিনি। বর্তমানে লুবানা সমমনা কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে স্পেশাল চাইল্ডদের জন্য ‘স্টেপ স্পেশাল চাইল্ড স্কুল’ নামের একটি বিশেষায়িত স্কুল পরিচালনা করছেন।লুবানার প্রতিবন্ধিতা জয়ের গল্পটা সহজ ছিল না। ১৯৯২ সালে ‘প্রিম্যাচিউর শিশু’ হিসেবে জন্ম নেওয়া শিশুটি ৪০ দিনের মাথায় আক্রান্ত হয় নিউমোনিয়ায়।
এরপর বেশ কিছুদিন অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয় তাকে। চিকিৎসকদের ধারণা, অতিরিক্ত অক্সিজেন দেওয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে জন্মলগ্নেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন লুবানা। ছয় বছর বয়সে মিরপুর ‘বিশেষ শিক্ষা’ স্কুলে পড়াশোনার হাতেখড়ি তার। শুরুটা কাগজ কলমেই হয়। পরে ব্যাপটিক মিশন ইনট্রিগ্রেটেড স্কুলে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ার মধ্য দিয়েই দৃষ্টিজয়ের লড়াই শুরু করেন তিনি। মিরপুর আইডিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং সরকারি সঙ্গীত কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। লুবানা ২০১৭ সালের পর বিশেষ শিক্ষার শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব স্পেশাল এডুকেশনের ওপর ডিগ্রি নেন এবং ব্যাচেলরে ফার্স্টক্লাস পাওয়ার উৎসাহে মাস্টার্স ডিগ্রিও সম্পন্ন করেন । এরপর টানা তিন বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ ও পরীক্ষা দিয়ে পার করেছেন কিন্তু কর্মসংস্থান জোটে নি লুবানার ভাগ্যে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা থেকে শুরু করে চাকরির জন্য যতগুলো প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা ও ইন্টারভিউ দিয়েছেন, সবখানেই শ্রুতলেখক নিয়ে ও নিয়োগ কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক দৃষ্টি, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন।
লুবানার মতো এমন অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন, যারা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবনবিমুখ হয়ে পড়ছেন, সার্বিক মানবাধিকার ভোগ করার সুযোগ থেকে পড়ছেন পিছিয়ে।
বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় প্রান্তিক ও অনগ্রসর গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যপীড়িত জনগোষ্ঠী প্রতিবন্ধী মানুষেরা। সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকৃত হলেও, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নাগরিক অধিকার ভোগের বাস্তবতা এখনও বেশ প্রতিকূল। তারা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সম্পত্তি, পরিবার গঠন এবং বিনোদনের মতো মৌলিক নাগরিক অধিকার প্রাপ্তির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বঞ্চনা, অবহেলা ও হয়রানির শিকার।
বর্তমানে দেশে ৪৬ লাখেরও বেশি প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮ শতাংশ। এদের মধ্যে মাত্র এক তৃতীয়াংশ কর্মক্ষম প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন, যারা কর্মে নিযুক্ত।
আবার দেখা যায়, দেশের অর্ধেকেরও বেশি প্রতিবন্ধী শিশুর আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই এবং ০ দশমিক ৪৮ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দেশের ৭০ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এবং বেশির ভাগ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ন্যূনতম চিকিৎসাসেবাও পান না প্রতিবন্ধী মানুষেরা।প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মানব বৈচিত্র্যের অংশ। জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদ (সিআরপিডি) স্বীকৃতি দেয় যে, ‘প্রতিবন্ধিতা একটি বিকাশমান ধারণা এবং এটি হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সঙ্গে আচরণগত ও পরিবেশগত বাধার মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কের পরিণতি, যা অন্যদের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে সমাজে পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাধাগ্রস্ত করে।’ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধিতার ১২টি ধরন রয়েছে। তবে সব ধরনের প্রতিবন্ধিতা দৃশ্যমান নয়।জাতিসংঘের মতে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা হচ্ছেন সমাজের বৃহত্তম বিভক্ত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। ঐতিহাসিকভাবেই দেখা যায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নাগরিক অধিকার সবসময় ছিল না।
বিশ্বের অনেক দেশে এখনও তারা এ অধিকার থেকে বঞ্চিত।বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নাগরিক অধিকারের বর্তমান পরিস্থিতিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পর্যায়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সনদ, আইন, নীতি ও বিধিমালা বিদ্যমান যা দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন ও তাদের মূলধারার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিভিন্ন নীতি, আইন, বিধিমালা প্রণয়ন, প্রকল্প ও কর্মসূচিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে প্রধানত রয়েছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ ও নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিভিন্ন নীতিমালা, প্রকল্প ও কর্মসূচি কার্যকর করার জন্য পরামর্শ প্রদান ইত্যাদি।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকৃত, এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও এর অন্তর্ভুক্ত। সংবিধানের ২৮নং অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী, পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না’। উপরিল্লেখিত অনুচ্ছেদটি ছাড়াও সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদে আরো কিছু অধিকারের কথা বলা হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির ন্যায় সমান অধিকার ভোগ করবে। এখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন দ্বারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার স্বীকৃত রয়েছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩” প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় একটি মাইলফলক। এ আইনের ধারা ১৬ এর উপ-ধারা (১) -এ প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির একাধিক নাগরিক অধিকার লাভের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি বিভিন্ন নীতিমালায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব নীতিমালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা ২০১৯, জাতীয় শ্রম নীতি ২০১২, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১, জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ এবং প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা ২০০৯। সেই সঙ্গে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদ (টঘঈজচউ)-এ বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। এই সনদ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।যদিও সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন নীতি, আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করেছে, তবে বাস্তব ক্ষেত্রে এই আইন ও নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ এবং সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে, বাজেট বরাদ্দ, মনিটরিং ব্যবস্থা এবং সচেতনতা সৃষ্টির অভাব রয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান, পরিবহন এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়াও, সমাজের একটি বড় অংশ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল নয় এবং তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকে। বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থা আরো শোচনীয়। সেখানে তাদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা বেশি এবং তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা খুবই সীমিত। খেলাধুলা, বিনোদন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ কম।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বিষয় নিয়ে কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুইড বাংলাদেশ। সংস্থাটির বাংলাদেশের মেন্টর জওয়াহেরুল ইসলামের মতে, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যে নাগরিক অধিকার আছে তার মধ্যে প্রথমেই আসে জন্ম নেওয়া, বেড়ে ওঠা- বিকশিত হওয়া, পরিবার গঠন করা, কর্মসংস্থানে যাওয়া, নিজের ক্ষমতায়ন করা, দাম্পত্য জীবন গড়া-এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের সংবিধানে এবং মানবাধিকার সনদের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমাদের দেশে যারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, প্রতিবন্ধিতার কারণে তারা সমাজের অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বাভাবিকভাবে তাদের নাগরিক অধিকারগুলো ভোগ করতে পারে না। আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে নাগরিক অধিকার থেকে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিতরা হলেন স্নায়ুবিকাশ প্রতিবন্ধী, যারা নিউরোডেভলপমেন্টালি প্রতিবন্ধী। অর্থাৎ, মস্তিষ্কের নার্ভ বা স্নায়ু যাদের দুর্বল, তারাই নাগরিক অধিকার থেকে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত।
তিনি বলেন, আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে প্রতিবন্ধী শিশু স্কুলে যাবে। স্কুল ভর্তি না করলে তা বৈষম্য বলে বিবেচিত হবে। যারা বাধা দেবে তাদের বিরুদ্ধে শিশুর অভিভাবক, স্কুল কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। তবে একটি প্রতিবন্ধী শিশুকে শুধু স্কুলে গেলেই হবে না, তার জন্য নিরাপদ রাস্তাঘাট, প্রবেশগম্যতা লাগবে। ঢালু পথ এবং র্যাম্প লাগবে যাতে হুইল চেয়ার যেতে পারে। স্কুলে শ্রেণিকক্ষে যাতে সে হুইল চেয়ার নিয়ে বসতে পারে, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। বাথরুম-টয়লেটে যে যেন স্বচ্ছন্দে যেতে পারে, সে ব্যবস্থা লাগবে। সেই শ্রেণিকক্ষে যে অপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা থাকবে, তাদের কাছে এবং তাদের অভিভাবকের কাছেও ওই প্রতিবন্ধী শিশুটির গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। প্রতিবন্ধী এই শিশুকে পড়ানোর মতো মেধাসম্পন্ন রিসোর্স শিক্ষকও লাগবে। যেমন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুকে ব্রেইল দিতে হবে কিংবা কম্পিউটার শিক্ষার ক্ষেত্রে রিড টু টেক্সট এবং টেক্সট টু স্পিচ প্রযুক্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে, ইশারা ভাষার জন্য লিপ রিডিং থাকতে হবে। আর স্নায়ুবিকাশজনিত প্রতিবন্ধীদের মধ্যে যারা অটিস্টিক বা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, ডাউনসিন্ড্রোমে আক্রান্ত তাদের জন্য বাস্তবভিত্তিক লাইফ স্কিল ডেভেলপমেন্টের শিক্ষা দিতে হবে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য এই ব্যবস্থাগুলো নেই।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন (১৩০ কোটি)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংক ২০১১ সালের যৌথ এক প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের হার ১৫ শতাংশ বলে উল্লেখ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন। এদিকে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত ‘প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ’ -এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান দেখা গেছে, দেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ৩৩ লাখের কিছু বেশি (২ শতাংশের আশেপাশে)। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১০’ বলছে, দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি( ৯.০৭ শতাংশ)। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ’ (এনএসপিডি)-২০২২ বলছে, দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ৪৬ লাখ ১০ হাজার। সমাজসেবা অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য দেখা যায়, দেশে নিবন্ধিত মোট প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা (১৭ জুলাই ২০২৫, তারিখ অনুযায়ী) ৩৬ লাখ ৩৬ হাজার ৯৩৩ জন। তবে ‘এনএসপিডি জরিপ ২০২১’ বলছে, দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিই সরকারি নিবন্ধের বাইরে রয়েছেন। এদিকে বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এ বলা হয়েছে , দেশের মোট প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ৭৪ দশমিক ২ শতাংশ গ্রামে এবং ২৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ শহরে বাস করে।
প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকারভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন উইমেন উইথ ডিজএ্যাবিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (ডাব্লিউডিডিএফ)। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার মিস্টির মতে, সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে প্রতিবন্ধী মানুষদের ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্র থেকে যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা, সেটি তারা পাচ্ছে না। অপরদিকে তাদের জন্য যে কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন, রাষ্ট্র সেভাবে পরিকল্পনাও করতে পারছে না। সুতরাং দেশের সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে শুধু সঠিক পরিসংখ্যানই নয়, ডিসএগ্রিগেটেডে ডাটা (জেন্ডার ও প্রতিবন্ধিতা-বিভাজিত তথ্য সংগ্রহ) প্রয়োজন। অর্থাৎ, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারী কতজন, পুরুষ কতজন? শিশুর মধ্যে মেয়ে শিশু এবং ছেলে শিশু কতজন? বৃদ্ধ কতজন- বৃদ্ধের মধ্যে পুরুষ এবং নারী কতজন?
ডাব্লিউডিডিএফ-এর এই দল নেতার মতে, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর পৃথক পৃথক এই তথ্য সংগ্রহের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে, সরকারকে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ীও ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেমন- সবার জন্য শিক্ষা কাঠামোতে সব ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও শিশুরা যুক্ত হতে পারলেও, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অর্থাৎ, যাদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা আছে, অটিজম আছে, ডাউনসিন্ড্রম আছে, তাদের জন্য আলাদা ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন। সেজন্য শিক্ষার ধারা অনুযায়ী তাদের জন্য বরাদ্দ প্রয়োজন। একজন প্রতিবন্ধী মানুষ শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও তার প্রতিবন্ধিতার কারণ ভিন্ন যেমন-স্পাইনাল কড ইনজুরি বা যদি সে পলিও এফেক্টেড হয়, তাহলে তাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগ প্রয়োজন হবে।
দেশে নিরক্ষর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মোট সংখ্যা ৬২ দশমিক ৮৯ শতাংশ (সাক্ষরতার হার অনুসারে ১৫ বছর এবং তার চেয়ে বেশি বয়সী)। ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ ২০২১’ অনুসারে, দেশের মোট ৬০ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। এই শিশুদের (৫-১৭ বছর বয়সী) মধ্যে মাত্র ৬৫ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং মাত্র ৩৫ শতাংশ শিশু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নথিভুক্ত আছে। শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এ দেখা যায়, দেশে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত মোট প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ০ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এনএসপিডি জরিপ আরো বলছে, দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৬৬ শতাংশ কোনো কাজে যুক্ত হতে পারেনি। অপর এক জরিপে বলা হয়েছে , দেশের প্রায় ৯৩ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত এবং পুরুষদের বেলায় এই হার ৫৯ শতাংশ। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি সংক্রান্ত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের ৭০ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এবং বেশির ভাগ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে (ইয়োথ পলিসি ফোরামের ওয়েব সাইট থেকে পাওয়া তথ্য মতে) প্রতিবন্ধী মানুষেরা ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত। আবার জাতীয় প্রতিবন্ধী জরিপ ২০২১ বলছে, দেশের ৩৭ দশমিক ০৯ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।
প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক গবেষক জওয়াহেরুল ইসলামের মতে, প্রতিবন্ধিতার জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজে নানা বাধা রয়েছে। এই বাধা দূর করার দায়িত্ব সরকারের, রাষ্ট্রের এবং সমাজের মানুষদের। সমাজ, রাষ্ট্র এবং সরকারের পক্ষে এই দেশে আইন আছে, সংবিধানের রূপরেখা আছে, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায়, দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এখনও পর্যন্ত সে অধিকারগুলো ভোগ করতে পারছে না।এই গবেষক বলেন, এই বৈষম্য দূর করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির জন্য ২০১৩ সালে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ নামের একটি আইন করা হয়েছে, যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্সংস্থান, দাম্পত্য, বিনোদন সবকিছুর ব্যবস্থার কথা বলা আছে। আবার সরকার তার মন্ত্রী, সচিব , উপদেষ্টারা নানা সভা-সেমিনারে অনেক টাকার হিসেব দিয়ে প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবি করছেন। কিন্তু বাস্তবে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়ন সেভাবে হচ্ছে না । কারণ যারা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা আমলাতন্ত্রের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা হয় এ বিষয়ে উদাসিন, নয়তো অনিহা-বৈষম্য করে হেলাফেলায় বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাগ্য উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া গবেষক জওয়াহেরুল ইসলামের মতে, দেশের বৈষম্যমূলক শিক্ষাক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই তিন মন্ত্রণালয়কে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করে এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যাতে স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধীবান্ধব সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই গবেষক বলেন, ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ এবং ১৯৭২ সালের ৭ নভেম্বরের বাংলাদেশের যে সংবিধান এবং ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যে সুরক্ষা আইন-এ সবই পিছিয়ে পড়া বা পিছিয়ে রাখা ভঙ্গুর প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর পক্ষে নেওয়া এক একটি অনন্য দলিল। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। এর প্রয়োগ করার দায়িত্ব দেশের সরকার এবং সরকারের পক্ষে তার কর্মচারীদের। তবে এ বিষয়ে এই কর্মচারীদের যেমন যথেষ্ট প্রশিক্ষণ নেই, তেমনি মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিও নেই। এজন্য কর্মী নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক পেশাকে ভাগ করতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ দেশের স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে র্যাম্প, লিফট বা হুইল চেয়ার চলাচলের সুব্যবস্থা না থাকা। তবে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা অন্তর্ভুক্তিমূলক এই সেবা প্রদানে বাধা সৃষ্টি করে।
তবে আশার কথা হচ্ছে, প্রতিবন্ধীবান্ধব বাংলাদেশ সরকার সমাজের পিছিয়ে থাকা প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জীবন-মান উন্নয়নে ও তাদেরকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্তকরণে ব্যাপক ও বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরনের সরকারি সেবা প্রদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মধ্যে প্রধান দায়িত্ব পালন করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর ও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন (জেপিইউএফ) সহ এর আওতাধীন সকল কার্যালয়। এছাড়া সমন্বিত সেবাদানের উদ্দেশ্যে যে সকল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। এছাড়া বিনোদন বা অন্যান্য সেবার প্রয়োজনে রয়েছে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কার্যালয়সমূহ এবং সেই সঙ্গে রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাইদুর রহমান বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গত বছরে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে আমরা ২ কোটি নাগরিককে সেবা দিয়েছি। ভাতা বিতরণে অনিয়ম ও বাদ পড়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি আরো বলেন, আমরা স্বচ্ছ গভর্নমেন্ট-টু-পার্সন ব্যবস্থার মাধ্যমে কমিটির যাচাইপূর্বক উপকারভোগীর তালিকা হালনাগাদ করছি। আমাদের সুদবিহীন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে সহায়তা করছে। বিশেষ শিক্ষা ও যত্নকেন্দ্র পরিচালনা করলেও আমরা সম্পদ ও জনবল সংকটে আছি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহ সম্পাদক
বিআলো/ইমরান