সাভার কলেজ ছাত্রদলে হাইব্রিড রাজনীতির দৌরাত্ম্য, ছাত্রলীগের প্রাক্তন এখন ছাত্রদলের সভাপতি!
ভাইরাল ছবিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মাহফুজ ইকবাল: দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেও বহাল গুরুত্বপূর্ণ পদে
সাভার কলেজ ছাত্রদলে বিতর্ক: “সাড়ে ৭ হাজার শিক্ষার্থীর কলেজে উন্মুক্তের সভাপতি”
ইবনে ফরহাদ তুরাগঃ সাভার সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি হিসেবে উন্মুক্ত বিভাগের শিক্ষার্থী ইমু ইমরানের ঘোষণা নিয়ে কলেজজুড়ে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কলেজে প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থী থাকা সত্ত্বেও একজন উন্মুক্ত বিভাগের শিক্ষার্থীকে সভাপতি করা হয়েছে, যার কোনো ডিপার্টমেন্ট বা আইডি কার্ড নেই। শিক্ষার্থীরা বলছেন, “এভাবে পদে রাখা হলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও নেতৃত্বের স্বীকৃতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।”
এক শিক্ষার্থী মন্তব্য করেন, “ইমু ইমরান কলেজে পড়াশোনা করছে, তবে সাধারণ শিক্ষার্থীর মতো ক্লাসে অংশ নেয় না, সহপাঠী নেই, এবং তাকে কেউ চেনে না। অথচ তাকে সভাপতি করা হয়েছে—এটা হাস্যকর।”
ছাত্রদলের পদ বিতরণে স্বজনপ্রীতি, বিতর্কিত রাজনৈতিক অতীত ও ছবি ভাইরাল

ভাইরাল ছবি: আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মাহফুজ ইকবাল
এদিকে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে একটি ছবি, যেখানে ঢাকা জেলা উত্তর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ ইকবাল স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ফুলেল শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। ছবিতে উপস্থিত ছিলেন এমপি সাইফুল ইসলাম ও উপজেলা চেয়ারম্যান রাজীব।
এ ঘটনার পর জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—কীভাবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেও তিনি বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছেন। এক বাসিন্দা বলেন, “এরা ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। এক কথায় গিরগিটির মতো। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত।”
এ নিয়ে ঢাকা জেলা উত্তর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ ইকবাল ও সাভার সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি ইমু ইমরানকে ঘিরে তৈরি হয়েছে তীব্র বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি, রাজনৈতিক অতীত ও নানা অভিযোগ থেকে ছাত্রসমাজ ও এলাকাবাসী প্রশ্ন তুলছেন—এই নেতারা কি প্রকৃত ছাত্রদলের প্রতিনিধিত্ব করছেন, নাকি রাজনৈতিক স্বার্থে পদে বসে আছেন? তারা কি সত্যিই ছাত্রদলের নেতা, নাকি ক্ষমতার পালাবদলে দলবদল করা “হাইব্রিড রাজনীতিবিদ”?
জনমনে প্রশ্ন—তারা কি প্রকৃত ছাত্রদলের নেতা, নাকি অতীতে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন?
এলাকাবাসীর অভিযোগ, মাহফুজ ইকবাল অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এক বাসিন্দা সোহেল রানা বলেন, “এরা ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। একই ব্যক্তি আরও বলেন, “এরা প্রকৃত আওয়ামী লীগের দোসর। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও বিভাগীয় তদন্তের জোর দাবি করছি।”
সরকারের আমলে মামলা নেই, দলের ভেতরে প্রশ্ন?
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মাহফুজ ইকবালের নামে বিএনপি-সংক্রান্ত কোনো মামলা হয়নি। অথচ দলীয় অনেক নেতাকর্মী এই সময়ে বারবার গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এতে ছাত্রদলের ভেতরও প্রশ্ন উঠেছে—তিনি কি সরকারের সঙ্গে আতাত করে নিজেকে রক্ষা করেছেন?
বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল, যেখানে বহু ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান নেতা রয়েছেন। এ অবস্থায় মাহফুজ ইকবালের মতো বিতর্কিত ব্যক্তির কর্মকাণ্ড দলকে কলুষিত করছে।
সাভার কলেজের সভাপতি ইমু ইমরান: বিতর্কের কেন্দ্র
একইভাবে, সাভার কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি ইমু ইমরানকেও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু বলা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ছাত্রলীগের কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন এবং এখন ছাত্রদলের সভাপতির পদে আছেন। ছাত্ররা বলছেন, “উন্মুক্ত বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ায় সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ পদে বসানো হয়েছে।” বিগত সরকারের আমলে ছাত্রলীগের নির্বাচনে তাদেরকে সক্রিয় অংশ নিতে দেখা গেছে। দুই সহোদরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, “টাকার জন্য তারা যেকোনো কিছু করতে সক্ষম।”
অভিযোগ রয়েছে, তিনি ছাত্রলীগের কার্যক্রমেও সক্রিয় ছিলেন এবং সাধারণ শিক্ষার্থী নন, বরং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কলেজে তাঁর কোনো বিভাগ বা আইডি কার্ড নেই। এ ঘটনায়, শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছেন সাভার কলেজ ক্যাম্পাসজুড়ে।
শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস জুড়ে প্রতিবাদ ক্ষোভ ও গণস্বাক্ষর
এ ঘটনায় প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা দেয়াল, গাড়ি এমনকি বিভিন্ন স্থানে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও, কেন্দ্রীয় কমিটির নীরব ভূমি নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। প্রশ্ন ওঠে—এত অনিয়ম ও অপকর্ম দেখেও কেন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না?
এক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ইমু ইমরান কলেজের উন্মুক্তের ছাত্র। কোনো ডিপার্টমেন্ট নেই, কোনো আইডি কার্ড নেই। অথচ সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থীর কলেজে তাকেই সভাপতি বানানো হয়েছে। এটা হাস্যকর।”
সাভার কলেজের অধ্যক্ষ: এই কমিটি অবৈধ
কলেজের অধ্যক্ষও মন্তব্য করেছেন, “এই কমিটি অবৈধ। তিনি বলেন, আমি অবসরে যেতে পারলেই বাঁচি।” এছাড়াও, রাজনৈতিক প্রভাব ও পারিবারিক যোগসূত্রের কারণে ইমরান বড় ভাই জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় পদে টিকে আছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ: টাকার বিনিময়ে পদ বণ্টন
অভিযোগ রয়েছে, সাভার সরকারি কলেজ, ধামরাই সরকারি কলেজ ও কুশুরা নবযুগ ডিগ্রি কলেজে কমিটিতে বহু আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মীর নাম রয়েছে। ধামরাই সরকারি কলেজ ছাত্রদল কমিটিতে সভাপতি ফাহাদ এবং সাধারণ সম্পাদক শশী—উভয়েই আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য বেনজির আহমেদের ঘনিষ্ঠ। অভিযোগ আছে, টাকা লেনদেন ও স্বজনপ্রীতির ভিত্তিতেই পদ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত সাভার কলেজে প্রকৃত ছাত্রদল কর্মীদের বাদ দিয়ে ইমু ইমরানকে সভাপতি করা হয়েছে। যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও কেন তাকে পদে রাখা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।
সাভার সরকারি কলেজের ৩য় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন,
“ইমু ইমরান উন্মুক্ত থেকে পড়াশোনা করেছে। কলেজে কোনো ডিপার্টমেন্ট নেই, আইডি কার্ডও নেই। সামনে যদি নির্বাচন হয় বা কমিটি ভেঙে দেয়, তাহলে আইডি কার্ড দেখাতে পারবে না। এখানে তাকে রেখে দেওয়া হাস্যকর।” শিক্ষার্থীরা আরও জানান, ইমু ইমরান সাভার কলেজের উন্মুক্ত বিভাগের ছাত্র। সাধারণ ছাত্রদের মতো ক্লাস করতে হয় না, সহপাঠী নেই, এবং তাকে চেনে না।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের আহ্বান
“ত্যাগী ও সত্যিকারের নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিয়ে বিতর্কিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা তাদের সঙ্গে চলতে চাই না।” শিক্ষার্থীরা বলেন, সাভার কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি ইমু ইমরানকে দল থেকে অব্যাহতি এবং মাহফুজ ইকবালের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও পারিবারিক যোগসূত্র
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ইমু ইমরান পূর্বে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও বর্তমানে ছাত্রদলের সভাপতি পদে বহাল আছেন। তার বড় ভাই ঢাকা জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় পারিবারিক প্রভাবেই তিনি পদে টিকে আছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাংবাদিককে হুমকি ও মামলা
একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক দিলশান আরা অনিমা প্রতিবেদন প্রকাশ করলে ইমু ইমরান ও মাহফুজ ইকবাল তাকে অস্ত্র দিয়ে হুমকি দেন। এ ঘটনায় ১০৭ ধারায় মামলা (নম্বর-৩৯৯) দায়ের হয়েছে। পাশাপাশি তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দোষীদের বিচারের দাবি জানান।
এ ঘটনায় প্রকাশ্যে আসে, রাজনৈতিক হাইব্রিড নেতাদের দৌড়াত্নে ছাত্রদলের কমিটি আওয়ামী লীগ থেকে আসা নেতাদের দখলে সাভার সরকারি কলেজের রাজনীতি। হাতে ক্ষমতা আর পকেটে টাকা থাকলেই দলের পদ পাওয়া যায়—ইমু ইমরান তার জীবন্ত প্রমাণ।
কলেজ কর্তৃপক্ষ বরাবর শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও গণস্বাক্ষর
১৮ জন শিক্ষার্থীর গণস্বাক্ষর সহ কলেজ কর্তৃপক্ষ বরাবর পক্ষকে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, ইমু ইমরান ২০২৫ সালের ১১ মার্চ সাভার সরকারি কলেজে ভর্তি হন এবং মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ২৬ মার্চ সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কোনো কর্মী সম্মেলন বা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হয়নি।
কমিটির সহ-সভাপতি ইমরান হাসান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রিচওয়াল দেওয়ানকেও একই অভিযোগের মধ্যে আনা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলেন, “প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থী থাকা সত্ত্বেও উন্মুক্ত বিভাগের শিক্ষার্থীকে সভাপতি করা হয়েছে।”
শিক্ষার্থীরা উল্লেখ করেন, কমিটি গঠনে চাঁদাবাজি ও অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে পদ বিতরণ হয়েছে। তারা বলেন, “ছাত্রদলের গৌরবময় ঐতিহ্য আজ প্রশ্নবিদ্ধ। নেতৃত্বে থাকলে উন্মুক্ত শিক্ষার্থী ও স্বজনপ্রীতি ভিত্তিক সুবিধাভোগী, তখন ছাত্রদলকে আদর্শিক সংগঠন বলা কঠিন।”
শিক্ষার্থীদের আহ্বান
সাভার সরকারি কলেজ ছাত্রদল ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, অভিযোগগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হোক এবং বর্তমান সভাপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করা হোক। শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, যদি কেন্দ্রীয় ছাত্রদল পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সাভার সরকারি কলেজে ছাত্রদলের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নীরবতা
শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলছেন—এত অনিয়ম, বিতর্কিত ছবি, আর্থিক লেনদেন ও আতাতের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদল কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না? তাদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে ত্যাগী নেতাদের প্রতি অন্যায় হচ্ছে এবং ছাত্রদলের ঐতিহ্য কলুষিত হচ্ছে।
বিআলো/নিউজ