গরীবের কাছে স্বপ্নের মতো এক টুকরো ইলিশ
dailybangla
19th Sep 2025 6:57 pm | অনলাইন সংস্করণ
ফারিহা জামান নাবিলা
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইলিশ শুধু মাছ নয়, বাঙালির সংস্কৃতি ও অনুভূতির এক অনন্য প্রতীক। পূর্ণিমার রাতে নদীতে জ্যোৎস্না পড়লে যেমন মনে হয় সোনালি রূপ ঝলমল করছে, তেমনি ইলিশের রূপালি ঝলক যেন বাঙালির খাবার টেবিলে আনন্দের আলো ছড়ায়। কিন্তু সেই আলো গরীব মানুষের ঘরে পৌঁছায় না। তাদের কাছে ইলিশ আজ স্বপ্নের মতো ছোঁয়া যায় না, শুধু কল্পনায় ভেসে ওঠে।
বাংলাদেশকে ইলিশের দেশ বলা হয়। বাংলাদেশে ইলিশ শুধু খাবার নয়, আবেগ। ঈদ হোক বা পূজা, অতিথি এলে কিংবা উৎসবের দিনে, ইলিশ ছাড়া যেন বাঙালির টেবিল অসম্পূর্ণ। কিন্তু এই আনন্দ সব ঘরে ভাগ হয়ে যায় না। শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, দিনমজুর কিংবা গ্রামীণ গরীব পরিবারগুলোর কাছে ইলিশ এখন বিলাসবস্তু। একসময় বাজারে গিয়ে ছোট একটা ইলিশ কেনা গেলেও এখন দাম আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ায় তাদের কাছে এটা একেবারেই নাগালের বাইরে চলে গেছে।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা কিংবা সাগর সব জায়গায় এই মাছের সমারোহ। প্রতিবছর দেশ-বিদেশে কোটি কোটি টাকার ইলিশ বিক্রি হয়। অথচ এ দেশের অনেক গরীব মানুষ বছরের পর বছর মুখে ইলিশ তুলে খেতে পারেন না। দাম এত বেশি যে সাধারণ শ্রমিক বা দিনমজুর পরিবারের কাছে এটা এখন বিলাসিতা।
দেশের প্রান্তিক শ্রমজীবী পরিবারগুলোর ৭০% বছরে একবারও ইলিশ কিনতে পারে না।অথচ বিশ্বে উৎপাদিত ইলিশের ৭০% এরও বেশি আসে এই দেশ থেকে। বতমানে মাঝারি আকারের এক কেজি ইলিশের দাম ১৫০০ টাকার উপরে। আর একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের মাসিক আয় গড়ে ১০-১২ হাজার টাকা। ফলে তাদের জন্য ইলিশ কেনা মানেই মাসের বাজেট ভেঙে যাওয়া।
ইলিশের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার পেছনে নানা কারণ কাজ করছে।নদী দূষণ, অতিরিক্ত নৌচলাচল, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ইলিশের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে ইলিশের প্রাপ্যতা কমে গেছে।জাটকা নিধন বন্ধ না হওয়া এবং প্রজনন মৌসুমে অবৈধ জাল ব্যবহার উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে।দালাল ও ব্যবসায়ী চক্র কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে মধ্যবিত্তও হিমশিম খায়, আর গরীবদের জন্য ইলিশ নাগালের বাইরেই থেকে যায়।উৎসবের মৌসুমে চাহিদা বেড়ে যায়, কিন্তু সরবরাহ সীমিত থাকে। এতে দাম দ্বিগুণ-তিগুণ হয়ে যায়।সব মিলিয়ে ইলিশ এখন সাধারণ মানুষের স্বপ্নের খাদ্যে পরিণত হয়েছে।
ইলিশের স্বাদ যেন কেবল ধনীদের জন্য সীমাবদ্ধ না থাকে সে জন্য সমস্যার সমাধান করতে হবে। কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারকে অবশ্যই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে এবং ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সরকারি রেশনিং ব্যবস্থায় ইলিশ সরবরাহ করা যেতে পারে। এতে অন্তত উৎসবের দিনে গরীব পরিবারগুলোও ইলিশের স্বাদ নিতে পারবে। জাটকা নিধন কঠোরভাবে দমন করতে হবে এবং প্রজনন মৌসুমে নদীতে বিশেষ নজরদারি চালাতে হবে। নদী দূষণ রোধেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইলিশ আহরণের মৌসুমে সঠিক সময়ে মাছ ধরার সুযোগ ও আর্থিক সহায়তা দিলে উৎপাদন বাড়বে।এসব উদ্যোগ কার্যকর হলে ইলিশের দাম কমে আসবে এবং সব শ্রেণির মানুষ সমানভাবে এর স্বাদ নিতে পারবে।
ইলিশকে যদি আমরা সত্যিই “জাতীয় মাছ” বলি, তবে তার স্বাদ কেবল ধনী-সম্ভ্রান্তদের জন্য সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। গরীব শিশুরাও যেন উৎসবের দিনে অন্তত এক টুকরো ইলিশ খেতে পারে এটাই হওয়া উচিত সমাজের দায়িত্ব। কারণ, ইলিশ শুধু রূপালি মাছ নয়, এটা বাঙালির স্বপ্ন, ভালোবাসা আর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। আর সেই স্বপ্ন থেকে গরীব মানুষকে বঞ্চিত করা মানেই তাদের আনন্দ কেড়ে নেওয়া।
বিআলো/ইমরান