অডিটের নামে মনগড়া-বিতর্কিত তথ্যের রচনা-রটনা রেলে
বিশেষ প্রতিবেদক: অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ১১ মাস যাবত তিনটি মন্ত্রণালয়কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ সময়টিতে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয় করেছেন নিজের তিন মন্ত্রণালয়ে। নিজের প্রতি জনআস্থাকে বাড়বাড়ন্ত করেছেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম কোন উপদেষ্টা যিনি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় উপহার পাওয়ার বিড়ম্বনার কথা তুলে ধরেছিলেন জনসম্মুখে। কোনো কোনো সময় তিনি নিজ ‘বিবেচনা’ মতো দামি ‘উপহার’ ফেরত দিয়ে নিজের নির্লোভ ও সৎ মানসিকতার কাগজে-কলমে প্রমাণ রেখেছেন। সম্প্রতি শ্রীলংকা সফরে গিয়ে ‘উপহার’ হিসেবে পাওয়া দামি ব্র্যান্ডের হাতঘড়ি দেশে ফিরেই মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি লিখে জমা দিয়েছিলেন সরকারি তোশাখানায়।
নিজের বাসায় থাকা আইপ্যাডটি পুরনো হলেও ভারতীয় একটি কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়া আইপ্যাডও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এই উপদেষ্টা একই সঙ্গে সামলাচ্ছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণায়ের দায়িত্বও। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতির পাগলা ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন তিনজন রেলমন্ত্রী। মেগাপ্রকল্পগুলোতে ব্যয় বাড়িয়ে অর্থ লোপাটের মচ্ছব চালিয়েছেন।
তরতর করে তুঙ্গে উঠা দুর্নীতি বন্ধে লাইনচ্যুত বাংলাদেশ রেলওয়েকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলতে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের কাঁধেই অর্পণ করেছিলেন রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। দায়িত্ব নিয়েই প্রথমেই তিনি নজর দেন রেলের বেশুমার দুর্নীতি বন্ধে, সরকারি প্রকল্পগুলোতে ব্যয় সাশ্রয় ও অপারেটিং রেশিও হ্রাস করতে।
তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বাছাই করেন একটি অভিজ্ঞ টিমকে। নিজে একদা আমলা ছিলেন বলেই পাকা জহুরির মতোই কাজের মানুষদের খুঁজে বের করেন। প্রশাসনে চৌকস হিসেবে পরিচিত সেতু বিভাগের সচিব ফাহিমুল ইসলামকে রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব করেন। অতীতে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় ডিজি পদে নিয়োগ হলেও ছাত্র-জনতার সমর্থনে দায়িত্ব পাওয়া অরাজনৈতিক সরকারের সময়ে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রকৌশল বিদ্যায় দক্ষ আফজাল হোসেনকে এই পদে নিয়োগ দেন। তাদের দু’জনকে দায়িত্ব দেন রেলের যাবতীয় দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধে।
গত এক বছরে তাঁরা দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ও যমুনা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পসহ ৫টি প্রকল্প থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয় করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ‘অভিজ্ঞ কাপ্তান’ হিসেবেই উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রেলের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীকেই লাগামছাড়া হতে দেননি। নিজেই সামগ্রিক বিষয় মনিটরিং করে সচিব ও ডিজির সমন্বয়ে ‘টিম ওয়ার্ক’ নিশ্চিত করেন।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও ইতোমধ্যেই পরীক্ষিত টিম ওয়ার্কের নমুনা বুঝে চোখে অন্ধকার দেখছে একটি সুযোগ-সন্ধানী ও পর্দার আড়ালের একাধিক চরিত্র। সরকারের এই উপদেষ্টা থেকে শুরু করে রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ডিজিকে নাস্তানাবুদ করতে অসত্য, অরুচিকর ও বিভ্রান্তিমূলক অপতথ্যের কারসাজির মাধ্যমে তাদেরকে ঘায়েল করতে উঠে-পড়ে লেগেছে। অডিটের নামে মনগড়া-বিতর্কিত কেচ্ছাকাহিনী রচনা আর রটনার জালে রেলকে বিপর্যস্ত করার অপতৎপরতার ঢোল বাজাচ্ছেন।
যদিও আশা মতো কাজ না হওয়ায় তাঁরা ক্ষুব্ধ-ক্রুব্ধ। কিছু কিছু মাধ্যমে এসবকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে রেলের পরিবর্তনের অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরির মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। রেলের দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধে যেখানে অন্তর্বর্তী সরকার বারবার নিজেদের সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়েছে, লুটপাট আর ভাগাভাগি প্রথাকে ‘সাজঘরে’ পাঠাতে জোর কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রেখেছে সেই সময়ে অশোভন ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যে মূলত রেলের টিম স্পিরিট আর মনোবল ভাঙাই যেন তাদের এক নম্বর এজেন্ডা হয়ে উঠেছে।
রেলে আতঙ্কের নাম ভুতুড়ে অডিট
গণমাধ্যমের কল্যাণে ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিলের ঘটনা সবারই জানা। কিন্তু এবার ‘ভুতুড়ে’ অডিটের খপ্পরে পড়েছে রেল। একের পর এক বিতর্কিত ও মনগড়া অডিটে জেরবার অবস্থা এখানকার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের। খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। সরকার অনুমোদিত এই প্রকল্পের ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। কিন্তু অডিট আপত্তি এসেছে ১৫ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ প্রকল্পের বাজেটের প্রায় ৪ গুণ বেশি। ফরেন এইডেড প্রজেক্ট অডিট ডিরেক্টরেট (ফাপাড)-বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট এই প্রকল্পটির অডিটের দিকে তাকালেই নজরে আসে অস্বাভাবিক ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের ছড়াছড়ির বিষয়টিও। ফাপাডের অডিট টিমের দলনেতা একেএম জুবায়ের থেকে শুরু করে সদস্যদের পরতে পরতে তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই প্রক্রিয়ায় গাফিলতি ও অপর্যাপ্ত নথিপত্র ও গবেষণার মানহীনতা রহস্যের জন্ম দিয়েছে।
তাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে রেলকে। বিভিন্ন মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির ন্যারেটিভ। বিশেষ করে যখন অডিট টিমের দলনেতা নিজেই স্বীকার করে নেন তাকে ‘হায়ার’ করে এই অডিটটি করা হয়েছে তখন সেটি আরও ভয়ানক। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেছেন, ‘আমাদেরকে এই অডিট আপত্তি তৈরিতে আমাকে ধার করে নেওয়া হয়েছিল।
আমরা একটি ড্রাফট করে অধিদপ্তরে জমা দেওয়ার পর বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প অডিট অধিদপ্তর সেক্টর-৫ এর উপপরিচালক শাহনেওয়াজ শাওন রিফাইন করে অডিট আপত্তি ফাইনালি সাবমিট করে থাকতে পারেন। আমরা ড্রাফট পর্যন্ত জানি, ফাইনাল রিপোর্ট সম্পর্কে আমরা জানিনা। অডিট আপত্তিকে সরাসরি দুর্নীতি বলা যাবে না। অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি যোগ্য।’
পুরো ঘটনাপ্রবাহকে রেলের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্রের বিষবাষ্প হিসেবেই দেখা হচ্ছে। সামনে যেটি বিদেশিদের আস্থা হ্রাসের জন্য যথেষ্ট। প্রায় একই রকম অবস্থা পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্প ও যমুনা রেলসেতু সংযোগ প্রকল্পের বেলাতেও। এই দু’টি অডিটেও হাজার হাজার কোটি টাকার অডিট আপত্তি উঠে এসেছে। ফলে এখানেও নিরীক্ষা দলের সদস্যদের পেশাগত দক্ষতা এবং অনুসন্ধান পদ্ধতির বিষয়টি এখন মিলিয়ন ডলার সিক্রেট কোয়েশ্চান।
অডিট আপত্তিকে সরাসরি দুর্নীতি বলা যায় না, এটি নিষ্পত্তি যোগ্য-একটি অডিট টিমের প্রধানের এই বক্তব্যের সূত্র ধরেই রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত একটি অডিট নিরীক্ষা অন্তে নিরীক্ষকরা তাদের মন্তব্য পেশ করেন যার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/কার্যালয় তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন এবং উভয়ের সমন্বয়ে দায় নির্ধারণ হয়।
অডিট আপত্তি কখনোই একটি ফৌজদারি তদন্ত নয়। বরং এটি একটি প্রশাসনিক পর্যবেক্ষণ, যেখানে সংশ্লিষ্ট অফিসের নিজস্ব ব্যাখ্যার জায়গা রয়েছে। সরকারি নথিপত্রে ‘অডিট আপত্তি’ শব্দটি ‘দুর্নীতি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িতই নয়। দুদক বা পুলিশের মাধ্যমে তদন্ত ছাড়া কিংবা আদালতের রায় ছাড়া কারো বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতির অভিযোগ’ তোলা শুধুই ‘মতামত’ বা ‘রাজনৈতিক ব্যাখ্যা’- যা কোনোভাবে আইনসিদ্ধ নয়। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-তে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে- বিধি ৩(ক): কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হলে লিখিত অভিযোগ, তদন্ত প্রতিবেদন এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।
কিন্তু এর আগেই কোন কোন মাধ্যমে অবান্তর ও অবাস্তব আষাঢ়ে গল্পে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে নানা কল্পকাহিনীর মাধ্যমে রেলের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সততা ও পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপতৎপরতা দৃশ্যমান হয়েছে। সরকারের কোন নিরীক্ষা প্রতিবেদন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কোনো অনুসন্ধান রিপোর্ট, আদালতের কোনো মামলা বা রায় না থাকা, সরকারি কোনো নথি না থাকলেও অনুমান নির্ভর একটি ন্যারেটিভ তৈরি করে আদতে এমন অপপ্রচারের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নকে বাঁধাগ্রস্ত করার নীল নকশা অঙ্কন করছেন পর্দার আড়াল থেকে অনৈতিক কায়দায় সুবিধা হাতিয়ে নিতে মরিয়া একটি চক্র।
১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয়ের পরেও কেন তিরস্কার
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা তিনমন্ত্রী কাছের লোকদের দিতেন নানা সুবিধা। অনেক অনিয়ম, দুর্নীতি হালাল করেছেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। গত এক বছরেও তাঁর বিরুদ্ধবাদীরাও উপদেষ্টার কোন কাছের লোকের তালাশ করতে পারেননি। তিনি রাজনৈতিক বিবেচনায় ও ঠিকাদারদের পরামর্শে প্রকল্প গ্রহণের চিরায়ত ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। রেলের শৃঙ্খলা ও প্রকল্প ব্যয় এভাবে কমিয়ে আনার অঙ্গীকার তিনি রক্ষা করেছেন গত এক বছরে। বন্ধ করেছেন টিকেট কালোবাজারী।
যাত্রী হয়রানিও নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। পলাতক আওয়ামী লীগের শাসনামলে অতিরিক্ত উন্নয়ন ব্যয় ধরে তৈরি কয়েকটি প্রকল্পের ব্যয় পুনর্মুল্যায়ন ও কাঁটছাট করে বর্তমান উপদেষ্টার নির্দেশে রেলের সচিব ও ডিজির সমন্বয় ও তদারকিতে রাষ্ট্রের তহবিল সাশ্রয় করা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। মূলত এসব প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, পূর্ত প্যাকেজ, পুনর্ভরণযোগ্য সিডি-ভ্যাট, পরামর্শক নিয়োগ ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনাসহ আনুষঙ্গিক খাত থেকে ব্যয় কমানো হয়েছে।
এর মধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ছয় হাজার ৬৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় কমানো হয়েছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ব্যয় কমানো হয়েছে ১ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত প্রকল্পে সরকারি অংশে ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে ৫৪১ কোটি ৩১ লাখ টাকা এবং প্রকল্প ঋণ অংশে ব্যয় কমেছে ১ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। এছাড়া আখাউড়া-লাকসাম রেল প্রকল্পে এক হাজার ৫০ কোটি টাকা, খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ১০০ কোটি ও যমুনা রেলওয়ে সেতু প্রকল্পে ৫০ কোটি টাকা ব্যয় কমছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পে ব্যয় কমানোর ঘটনাকে সাধুবাদ দিলেও চোখে-মুখে অন্ধকার দেখা গুজববাজরা করে চলেছেন তিরস্কার। থামছে না তাদের অপপ্রচার।
নিস/বিআলো/এফএইচএস



