ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবস, যা ভাবছেন নারী শিক্ষার্থীরা

ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবস, যা ভাবছেন নারী শিক্ষার্থীরা

মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ: নারী-পুরুষ দুজনেই সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ নারীরা এ সমাজে আজো যৌন নিপীড়নের শিকার।  প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিকভাবে অপদস্ত হতে হচ্ছে তাদের। ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবস আজ।

ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে যৌন নিপীড়নের মতো ভয়াবহ ব্যাধি থেকে নারীসমাজকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৩ জুনকে ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং ২০১০ সাল থেকে নিজস্ব কার্যক্রম নিয়ে জাতীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে দিনটি।  

দিনটিকে কেন্দ্র করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন নারী শিক্ষার্থীর ভাবনা ও মতামত তুলে ধরেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।

এখানে এসব মতামত তুলে দেওয়া হলো:

ইভটিজিং মুক্ত সমাজ চাই

ইভটিজিং এর থাবা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না ছোট্ট শিশু থেকে বৃদ্ধ নারীরাও। পারিবারিক সামাজিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপসংস্কৃতি ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, ভুক্তভোগীদের প্রতিবাদে অনীহা, বইবিমুখ মানসিকতা, প্রযুক্তির অপপ্রভাব, বিনোদনে অশ্লীলতা প্রদর্শনসহ নানা কারণে যৌন হয়রানিকে প্রতিহত করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া আমাদের দেশে নারীরা আজও আর্থিকভাবে পুরোপুরি মুক্ত না হওয়ায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাদের আজও অবদমন করেই রাখা হয়। পাশাপাশি উচ্চ ক্ষমতার প্রভাব ও রাজনৈতিক জটিলতার কারণে ইভটিজিং আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হয় অনেকসময়ই। ফলে প্রতিনিয়ত নারীদের লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে।

কর্মক্ষেত্রে বিশেষ করে পোশাকশ্রমিক নারীদের অবস্থা আরও করুণ। করোনাকালীন সময়ে এর প্রাদুর্ভাব যেন আরও বেড়েছে। এর থেকে নারী সমাজকে রক্ষা করা জরুরি। যৌন হয়রানি নিরোধে সংগঠনগুলোকে আরও সোচ্চার হতে হবে। বেশি বেশি সামাজিক আলোচনা অনুষ্ঠান, ব্যানার প্রদর্শনসহ নানাভাবে ইভটিজিং প্রতিরোধে লোকসমাজের দৃষ্টি আর্কষণ করতে হবে। ইভটিজিং আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। শিশুর বেড়ে ওঠার নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অপ্রয়োজনে প্রযুক্তি ব্যবহার না করা, নারীকেও মানুষ ভাবার মনোভাব ও বেশি বেশি বই পড়া ও সুষ্ঠু বিনোদনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।  এছাড়া, নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধিতে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই ইভটিজিংকে প্রতিরোধ করতে পারে।

-রুকাইয়া মিজান মিমি, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সচেতনতাই ইভটিজিং রোধে সহায়ক

ইভটিজিং একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। যেটি একজন নারীর জীবনকে বিষিয়ে তুলছে দিন কে দিন। করোনা ভাইরাসের মত মহামারীর সময় কালে ও থেমে নেই নারীদের ইভটিজিং করার প্রবণতা।  বিভিন্নভাবে ছেলেরা কিশোরী অথবা নারীদেরকে রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত করার মাধ্যমে ইভটিজিংকে সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত করে তুলেছে। জনসম্মুক্ষে একজন নারীকে অসম্মান করা অথবা শিস দিয়ে ডাকা, বা মেয়েটির পিছু নেওয়া ইত্যাদি কাজই মূলত ইভটিজিং এর আওতাভুক্ত।

এছাড়া পারিবারিকভাবে ও মেয়েরা নানা ভাবে ইভটিজিংএর শিকার হচ্ছে। ইভটিজিং এর কারণে নারী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নারীদের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হচ্ছে এই ঘৃণিত কাজের জন্য। নারীরা সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারছে না, আবার চরম মাত্রাতীত অত্যাচারের শিকার হয়ে যখন নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তখন আমাদের সমাজ নারীকেই দোষী ভাবে। তাই আমরা চাই অতিসত্বর এই ধরনের সামাজিক ব্যাধি আমাদের সমাজ এবং আমাদের নারীদের জীবন দূর হয়ে যাক চিরতরে। ইভটিজিং যেন আর কোন মহামারী রূপ ধারণ করতে না পারে সেজন্য সমাজের সকলের সচেতনতা বোধের উদয় হোক। ইভটিজিং প্রতিরোধে প্রশাসনের সদয় দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

-সানজিদা মাহমুদ মিষ্টি, শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বন্ধ হোক নারী উত্ত্যক্তকরণ

বর্তমান সমাজে নারী উত্ত্যক্তকরণ অর্থাৎ ইভটিজিং একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ইভটিজাররা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া, তাদের অশালীন মন্তব্য, বিকৃতি নামে ডাকা, উপহাস-তুচ্ছ করা, অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা‌। এর দরুন মেয়েরা আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। যা থেকে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এই বিশৃঙ্খলা নিরাময়ের জন্য নারী-পুরুষ উভয়ের সোচ্চার হয়ে উঠতে হবে। নারীর অধিকার আদায়ে হতে হবে সচেতন। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টি ভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।নারীকে প্রাপ্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে। আমাদের শিশুদের এসব সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্ব কর্তব্য পালন করার শেখাতে হবে পাশাপাশি প্রাপ্ত বয়স্কদের নারীদের উত্ত্যক্ত না করার আহ্বান করতে হবে। নারীর প্রতি সম্মানবোধ করা ও নারীর অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে। উত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারী উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

-জান্নাতুল মাওয়া শশী শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ইভটিজিং প্রতিরোধে পারিবারিক সচেতনতা জরুরি

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের হাজারো সমস্যার মধ্যে বর্তমানে অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইভটিজিং। আর প্রতিনিয়ত এই ভয়ঙ্কর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে স্কুল-কলেজগামী ছাত্রী, শিক্ষিকা, অন্যান্য কর্মজীবী নারীসহ প্রায় প্রতিটি নারীই, এমনকি ছোট শিশুকেও এর শিকার হতে হচ্ছে। এই ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের কাছে আরো বেশি নির্যাতিত হচ্ছে নারীরা। যার ফলে ইভটিজিং এর শিকার হওয়া নারীদের অধিকাংশই বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। নারীদের আত্নহত্যা থেকে বাঁচাতে  ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে কঠোর আইনের ব্যবস্থা, ইভটিজিং কারীদের শাস্তি প্রদান, জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করলেও এ সমস্যা যেন সমাজে থেকেই যাচ্ছে।

জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে দেশের প্রায় ৮৪% নারীই ইভটিজিং এর শিকার। এমতাবস্থায় পারিবারিক সচেতনতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কেননা পারিবারিক সংস্কৃতিই ইভটিজিং প্রতিরোধে মূল ভূমিকা পালন করবে। বাবা-মা কে অবশ্যই তার ছেলেমেয়েদের দৈনন্দিন কাজের দিকে নজর দিতে হবে। সন্তানদের দিকে বাবা-মায়ের সঠিক নজর থাকলে তাদের বিপথগামী হওয়ার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে, ইভটিজিং এর মতো অনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়ার প্রবণতা কমবে। এছাড়া নারীদের প্রতি সম্মানবোধ তৈরির ক্ষেত্রেও পরিবারই মূল ভূমিকা রাখে। ইভটিজিং প্রতিরোধে তাই পরিবারকেই সর্বপ্রথম এগিয়ে আসতে হবে।

-সিদরাতুল মুনতাহা, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বিআলো/ইলিয়াস