করোনা ভাইরাস ও বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরঃ "টিকিয়া থাকাই হইবে চরম স্বার্থকতা"

করোনা ভাইরাস ও বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরঃ "টিকিয়া থাকাই হইবে চরম স্বার্থকতা"

শেখ মোহাম্মদ সাব্বির হোসেন (এভিপি এন্ড ম্যানেজার, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিঃ) : ইতিহাসের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর। অতীতে বিভিন্ন সময়ে কোন কোন নির্দিষ্ট ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়লেও সম্পূর্ণ ইন্ডাষ্ট্রির অস্তিত্ব সংকটের ঝুঁকি এই প্রথম। এমনিতেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর বরাবরই একটু অতিরঞ্জিত। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের চাপে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যাংকের অনুমোদনের কারণে একটা অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা বিরাজ করে আসছিল। ইন্ডাস্ট্রির একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যাংক যখন বিভিন্ন সমস্যায় ধুঁকছে, তখনি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে চাপিয়ে দেয়া হলো নয়-ছয় হার। ব্যবসায়ীদের ক্রমাগত চাপের মুখে কোনরকম প্বার্শপ্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা না করেই সরকার ব্যাংকগুলোর উপর এই নতুন নিয়ম কার্যকর করে।

যেহেতু মার্কেটের ৬০ টি ব্যাংক সমশক্তির নয়, তাই শক্তিশালী, দূর্বল বা মাঝারি মানের সকল ব্যাংকগুলোর জন্য স্বল্পনোটিশে প্রযোজ্য এ নিয়মের কারনে দূর্বল বা নতুন ব্যাংকগুলো তাদের অস্তিত্ব কতটুকু টিকিয়ে রাখতে পারবে-সেটা বিশ্লেষণ সাপেক্ষ। কারণ, দুর্বল ভিত্তির বা নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকগুলোতে প্রায়ই তারল্য সংকট থাকে। এই সংকট কাটাতে তারা গ্রাহকদের নিকট থেকে উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহ করে। স্বভাবতই তাদের ঋণের সুদের হারও বেড়ে যায়। কিন্তু ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ পার্সেন্ট করায়, দূর্বল ও নতুন ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। আর আমানতের সুদের হার কমে আসলে আমানতকারীরা দূর্বল বা নতুন ব্যাংকের পরিবর্তে তুলনামূলক পুরোনো ও শক্তিশালী ব্যাংকেই আমানত রাখতে উৎসাহিত হবে। কারণ সাম্প্রতিক অতীতে ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকদের মধ্যে একটা বড় আস্থার সংকট তৈরি করেছে। এতো গেল গ্রাহকদের পছন্দ, যদি গ্রাহকেরা আদৌ ব্যাংকে আমানত রাখতে আগ্রহী থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পাঁচ ছয় পার্সেন্ট হারে গ্রাহক ব্যাংকে আমানত রাখবে কিনা। পোস্ট অফিস বা সঞ্চয়পত্রেই তো এর চেয়ে বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে। আর শেয়ার বাজার কিংবা ফটকা ব্যবসাতো আছেই। সেক্ষেত্রে টাকা চলে যাবে ব্যাংক থেকে এবং শুরু হবে তীব্র তারল্য সংকট। অন্যদিকে ঋণের সুদের হার কমে নাইন পার্সেন্টে নেমে আসায় ঋণের চাহিদা বাড়বে। কিন্তু তারল্য সংকটের কারণে যোগান পর্যাপ্ত থাকবে না। সবচেয়ে বড় কথা, নয়-ছয় এর আল্টিমেট বেনিফিশিয়ারী বড় ব্যবসায়ীরা, যারা আসলে পলিসি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্ত এই সমস্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকেই একেবারে গৌণ করে দিয়েছে "কোভিড ১৯ প্যানডেমিক"। এখন দেখার বিষয় করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি ব্যাংকিং সেক্টর কিভাবে সামাল দেয়। আরও দেখার বিষয় করোনা পরবর্তী "সময়কাল" কবে আসবে।

বিগত একমাসেরও বেশি সময়  যাবৎ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এবং এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাত প্রায় বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে অন্যান্য শিল্পখাত সহ সমগ্র ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। রেমিটেন্স প্রবাহ থেমে গেছে, একের পর এক বাতিল হচ্ছে রপ্তানি ক্রয়াদেশ। সরকারের পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ পঁচাত্তর হাজার কোটিতেই থাকবে নাকি আরও কয়েকগুন বাড়বে? শতকরা কতভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আবার মাথা তুলে দাড়াতে পারবে? এসবই এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তবে যখনই হোক-  এই দূর্যোগপূর্ণ সময় পেরোনোর পর প্রতিটা ব্যাংকের জন্য হবে একটা চ্যালেঞ্জিং সময়। সেই চ্যালেঞ্জ নিজের সাথে নিজের। "টিকিয়া থাকাই হইবে, চরম স্বার্থকতা"॥