করোনাকালে এই মুহূর্তে করণীয়

করোনাকালে এই মুহূর্তে করণীয়

অধ্যাপক ডা: মো: শারফুদ্দিন আহমেদ: ৮ই মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত বেড়েই চলেছে। এর ফলে বহু চিকিৎসক, রাজনীতিক, পুলিশ, ব্যাংকার, সাংবাদিক ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ মৃত্যুবরণ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা সংকট উত্তরণের জন্য এক লক্ষ কোটি টাকারও অধিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। বর্তমানে প্রায় ৬৫,০০০ এর বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং ৯০০ এর অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এ অবস্থায় জীবন ও জীবিকা তথা অর্থনীতি সচল করার লক্ষ্যে সীমিত আকারে অফিস-আদালত, কলকারখানা, দোকানপাট খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে যারাই ঘরের বাইরে যাবে তাদেরকে কঠোর ভাবে স্বাস্থবিধি মেনে চলতে হবে। স্বাস্থবিধি বলতে মাস্ক ব্যবহার, ১ মিটার দূরত্ব বজায়, ঘন ঘন হাত ধোয়া বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার এর ব্যবহার অব্যাহত রাখতে হবে। হাসপাতাল গুলোতে ফ্রন্টলাইনার হিসেবে সরাসরি করোনারোগী চিকিৎসা করার কারণে চিকিৎসক, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যপকভাবে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। কারণ হিসেবে প্রথমদিকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম: মাস্ক, পি.পি.ই নিম্ন মানের হওয়ায় আক্রান্তের হার বাড়ে। এমনকি এই পি.পি.ই ব্যবহার বিধি (Doning & Dofing) এর Training ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যা হয়। কর্মরত চিকিৎসকগণ তার পরিবারে ফিরে আসার মাধ্যমে পরিবারের সবাই আক্রান্ত হয়। এক্ষেত্রে বিস্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে ১০দিন ডিউটি করার পর পরবর্তী ১১দিন আইসোলেশনে থাকার জন্য বাসার পরিবর্তে হোটেল বা অন্য কোনো স্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে এই বিষয়ে সমন্বয়হীনতা ছিল; যার ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে। আরেকটি বিষয় হল আমাদের দেশে করোনা টেস্টের ক্ষেত্রে আগ্রহী অনেকেই টেস্ট করতে না পারায় এবং টেস্তের সরঞ্জামাদি কম থাকায় সনাক্তকরণের পরিমাণ যথাযথ নয়। এছাড়া আক্রান্ত অনেকেই উপসর্গ হীন থাকায় অনেক স্বাভাবিক ব্যক্তি তাদের মাধ্যমে আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসা করাতে এসেও অন্যান্য স্বাভাবিক রোগী এবং চিকিৎসক-নার্সদেরকেও আক্রান্ত করছে। এই উপসর্গ হীন রোগীর মাধ্যমে ফ্রন্টলাইনার চিকিৎসক, নার্স, সাংবাদিক, পুলিশগণ বেশিরভাগ সংক্রমিত হচ্ছেন। শিফটিং ডিউটি এবং মাস্ক ব্যবহারের মাধ্যমে ফ্রন্টলাইনারগণ সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

যে সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী বয়স্ক এবং কো-মরবিড (উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, কিডনি রোগ, শ্বাসকষ্ট রোগী)-দের অনলাইনে অফিস করা উচিৎ। অফিস স্টাফের সংখ্যাও কমানো উচিৎ। উপসর্গ নিয়ে কেউ যেন অফিসে না আসে সেই বিষয়টি অফিস প্রধানগণকে নিশ্চিত করতে হবে। এই অচেনা রোগটি কখন কাকে অক্রমণ করবে কেউ জানে না। তাই ব্যক্তিগত সুরক্ষার মাধ্যমে অর্থনীতি সচল করার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে। বিগত ৬৬ দিনের লকডাউনে অকল্পনীয় অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশের মত মধ্যম আয়ের দেশে চার লাখ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ কোটি লোককে খাদ্য প্রদান, ৫০ লক্ষ লোক কে নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন। এখন সকল ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য শুধু সরকার নয়, দলমত নির্বিশেষে বিত্তবান সকলকে মুক্তহস্তে এগিয়ে আসতে হবে। করোনার সাথে বসবাস করলেও যাতে করোনা আক্রমণ করতে না পারে তার জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক। ঘরে তৈরি কাপড় বা গেঞ্জির মাস্ক কয়েকটি রাখতে হবে এবং একবার ব্যবহার করার পর তা পরিষ্কার করে ব্যবহার করতে হবে। সৌদি আরবে মাস্ক ব্যবহার না করলে ১০০০ রিয়াল জরিমানা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ঘরের বাইরে বের হতে হলে আমাদেরকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে অথবা ৫০০ টাকা জরিমানা করা যেতে পারে। আইনের প্রয়োগের চেয়ে জনসচেতনতা জরুরি। এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে করোনার ভয়কে জয় করে অর্থনীতিকে সচল করা সম্ভব হবে।

COVID-19 এমন একটি ভাইরাস যা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের প্রতিনিয়ত শিক্ষা দিচ্ছে। নতুন স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য যেসব জেলায় ৩০০ এর অধিক রোগী রয়েছে, সে এলাকাকে লাল অঞ্চল চিহ্নিত করে লকডাউন বা কার্ফিউ জারি করা উচিৎ। ১০০ থেকে ৩০০ রোগী যেসব জেলায়, তাদেরকে হলুদ অঞ্চল ঘোষণা করে সীমিত আকারে অফিস-আদালত বা যানবাহন চলবে। আর যেসব এলাকায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০০ এর কম, সেসব এলাকাকে সবুজ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যেতে পারে। এই করোনা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যে অচল অবস্থা, তা সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তাই ভবিষ্যতে মূল বাজেটের শতকরা ১২ শতাংশ অথবা জিডিপি ৫ শতাংশ বাজেট স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্যব্যবস্থাপণায় যে সমন্বয়হীনতা আছে, কৃত্যপেশাভিত্তিক স্বাস্থ্য প্রশাসনের মাধ্যমে তা দূর করা সম্ভব। বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনুপাতে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্য জনশক্তি নিয়োগ করা প্রয়োজন। সাথে সাথে স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদি এবং হাসাপাতাল ব্যবস্থাপণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা প্রয়োজন। 

করোনা কে ভয় নয়, বরং সচেতনতা এবং আন্তরিকভাবে ব্যক্তিগত সুরক্ষা অবলম্বন করার মাধ্যমে আমরা 'নতুন' স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সক্ষম হব।

অধ্যাপক ডা: মো: শারফুদ্দিন আহমেদ
সাবেক মহাসচিব, বিএমএ
সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়