করোনাকালে শিশু-কিশোরের সঙ্গে উদ্বেগ সামলে আশ্বস্ত করুন

করোনাকালে শিশু-কিশোরের সঙ্গে উদ্বেগ সামলে আশ্বস্ত করুন
শাহনাজ পলি


শাহনাজ পলি: সারাবিশ্ব যখন করোনা মহামারীর কবলে তখন অভিভাবকের দায়িত্ব বেড়েছে দ্বিগুন। একদিকে পরিবারের সুরক্ষা অন্যদিকে শিশু কিশোরদের বাড়তি যত্ন। প্রতিটি বাড়িতেই দুই একটি শিশু বা কিশোর আছেই। করোনার ক্রান্তিকালে থেমে গেছে শিশুদের দূরন্তপনা। নেই বিদ্যালয়ে যাওয়ার তাড়া বা কচিং সেন্টারে পদচারণা। সপ্তাহের প্রায় সাত দিনই যাদের যন্ত্রের মত চলতে হত এখন তারা নির্বিকার। অনির্দিষ্টকালের জন্য থমকে আছে তাদের শিক্ষাজীবন, খেলাধুলা। ঘরবন্দি এসব শিশু-কিশোরদের মুখের দিকে তাকানোই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে অভিভাবকদের।

একটু ফুরসত পেলেই যে শিশু বা কিশোর খেলাধুলা করা, বাইরে খেতে যাওয়া বা বেড়াতে যাওয়ার বায়না ধরত এখন আর তা করে না। একটু একটু করে তারাও বুঝে গেছে এ সময়টা ঘরের বাইরে অনিরাপদ। নানা কৌশলে অভিভাবকরা তাদের ঘরে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। আবার অনেকে নিজে থেকেই বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। কম্পিউটারে গেম খেলে, মোবাইলে চোখ রেখে, নাটক সিনেমা বা গল্পের বই পড়ে অলস সময় পার করছেন শিশু-কিশোর-যুবক। কখনও আবার অবসন্ন হয়ে চুপচুপ ঘরের কোনে নিজেকে এলিয়ে দিচ্ছে, অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ছে বা রাতের বেশিরভাগ সময় অনিদ্রায় কাটাচ্ছে। কম বেশি সব পরিবারই বিভিষিকাময় পরিস্থিতির মুখে। 
  
রাফসান আর রিহাম জমজ দুই সন্তানের মা রওশন রাজধানীর একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা। ওই স্কুলের ৮ম শ্রেনীর ছাত্র তারা। জেএসসি পরীক্ষার্থী। তাই বছরের শুরুতেই খুব মনযোগ দিয়ে পড়াশুনা শুরু করেছিল ঠিকই কিন্তু হঠাৎই স্কুল বন্ধ। কয়েকদিন বই পত্র নিয়ে নিয়ম মতো পড়তে বসলেও মাস খানেক পরেই তাদের উৎসাহে ভাটা পড়ল। নতুন ক্লাস, বই, সিলেবাস সব যেন গুলিয়ে ফেলল। মা-বাবা দুজনেই তাদের সঙ্গে পড়াশুনা নিয়ে আলাপ করে উৎসাহ দেয়ার চেষ্টা করলেও তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। খাবারের প্রতিও অনিহা। রুচি পরিবর্তনে খাবারে বৈচিত্র আনার চেষ্টা করেন মা রওশন। বাড়তি প্ররিশ্রম করে তিনি নিজেও ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। একদিকে পরিবারের এমন হাল অন্যদিকে করোনায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওদের বাবাও মাঝে মাঝে চিন্তায় মুষড়ে পড়ছেন।
প্রথম সন্তানের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল পেয়ে খুশি হলেও তেমন উচ্ছ¦সিত হতে পারেননি তিন সন্তানের জননি তাহমিনা মুন্নি। অথচ কত পরিকল্পনাই না করেছিলেন। প্রায় দুই বছর মেয়ের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোথাও বেড়াতে যাননি বা খুব প্রয়োজন ছাড়া কোন উৎসবেও যোগ দেননি। মেয়েটা ভাল রেজাল্ট করল অথচ মেন একটা আনন্দঘন সময়ে মিষ্টির আয়োজন করতে পারেননি। পারেননি আত্মীয় বা প্রতিবেশিকে মিষ্টি মুখ করাতে। নিরানন্দই কেঠে গেছে অধীর অপেক্ষা করা অতি আনন্দের মুহুর্ত। কলেজে ভর্তি নিয়েও অনিশ্চয়তা দানা বেধেছে পরিবারটিতে।

ভিকারুন্নিসা কলেজের শিক্ষার্থী মাইশার উদ্বেগ-উৎকন্ঠা চরমে কারন সে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। স্বাভাবিক নিয়মে এতদিনে পরীক্ষা শেষ হেয় যাওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষাতো দুরের কথা কবে এই করোনা থেকে মুক্তি পাবে, নতুন করে পড়ায় মন বসাবে, পরীক্ষা দেবে সে আশঙ্কায় হতাশ হয়ে পড়েছে মাইশা ও তার অভিবাবক।

ব্যাংকার রিমির পরিবারে করোনা নিয়ে বাড়তি উদ্বেগ। স্বামী স্ত্রী দুজনেই ব্যাংকে চাকরি করেন। লকডাউন তুলে নেয়ার পর ছোট ছোট শিশু দুটিকে রেখে তাদের অফিসে যেতে হয়। কাজের মেয়ে ওদের দেখাশুনা করে,  তারা এতেই অভ্যস্ত। কিন্তু বিপত্তিটা হচ্ছে করোনা ভাইরাস। সারাদিন বাবা-মায়ের জন্য অপেক্ষার পর বিকেলে কলিং বেল বাজলেই দৌঁড়ে একজন বাবার কোলে তো অন্যজন মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। তীব্র ছোঁয়াচে করোনা ভাইরাস থেকে সচেতনতায় বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে শিশুদের বুকে টেন নিতে পারেন না রিমি। জীবুণূমুক্ত হয়ে বাচ্চাদের সামলাতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।   

করোনা স্পেশাল মুগদা জেনারের হাসপাতালের হাসপাতালের ডাক্তার সিনথিয়া পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই সপ্তাহ হাসপাতালে রয়েছেন। রোজার দিনে মোবাইলে ভিডিও কল দিয়ে দুই সন্তানের সঙ্গে ইফতার করেন। ১৩ বছর বয়সী মেয়ে নওরিন বিষয়টা বেশ বুঝে কিন্তু ৭ বছরের সাদমান অনেকটাই অবুঝ। বাবা মাকে ছাড়া তার মন খারাপ। টেলিভিশনে করোনায় আক্রান্ত বা মুত্যুর খবর দেখে ভীত। বোনের কাছে জানতে চায় মহামারী কি? নীরবে চোখ মুছেন তাদের মা।   
  
করোনার এই ক্রান্তিকালে নানা সমস্যার মুখোমুখি কম বেশি সব পরিবারই। যে সময়টায় ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় প্রবল চাপ থাকার কথা সে সময়টা অবহেলা করে কাটাতে হচ্ছে। খেলাধুলায় বাধা, এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজ চর্চাও নেই। কী একটা ভীতিকর পরিবেশ। যেসব শিক্ষার্থী পড়াশুনায় খুব বেশি সিরিয়াস না এই করোনাকাল তাদের বেশি ক্ষতি হচ্ছে। পিছিয়ে পড়া এসব শিক্ষার্থীদের সাময়িক এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার যোগ্যতা কম। একদিকে প্রাণঘাতি ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই অন্যদিকে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত। মেধা শক্তির এই জট খুলতে অনেকটাই খেসারত দিতে হবে বৈকি।  

কলেজ শিক্ষক আহসান হাবিব করোনার ভয়াবহতায় ঘরে আটকে থাকা সময়কে সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগানোর উপায় হিসেবে বইপড়াকে বেছে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যেহেতু এখন শিক্ষার্থীদের ক্লাস বা কোচিংয়ের চাপ নেই। এই ঘরবন্দি সময়ে যেন তরুণদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেজন্য ঘরে বসে গল্প, উপন্যস বা বিজ্ঞান বিষয়ক বই পড়ে সময়টাকে সদ্ব্যবহার করার উপদেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন অভিভাবকরা।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাইকোলজিস্ট ড. মনোয়ারা পারভীনের পরামর্শ মতে, এই করোনাকালে পরিবারের বড়দের আগে উদ্বেগ সামলে উঠা দরকার। শিশুদের করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে আশ্বস্ত করুন। মহামারীর কারণে চারপাশের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন, এটা স্বাভাবিক। তবে বড়দের যেকোনো মনোভাব অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুর মনে প্রবাহিত হয়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে উচিৎ আগে নিজেকে সামলিয়ে শিশুর দিকে নজর দেয়া। 

করোনা ভাইরাসের লক্ষণ সাধারণ জ্বর ও ঠান্ডা-কাশির মতো হওয়ায় শিশুরা এসব রোগে অল্পতেই ভয় পেয়ে যেতে পারে। এসময় তাদের এই ব্যাপারে আশ্বস্ত করা খুবই জরুরি যাতে তারা অল্পতেই ভেঙে না পড়ে। করোনা সংক্রমণ এবং প্রতিরোধে করণীয় কী, এই বিষয়ে আপনার শিশুকে অবহিত করুন। ছোটরা সাধারণত বড়দের দেখেই শেখে। তাই নিজে সচেতন হয়ে নিয়মিত নিজেকে পরিষ্কার রাখেন, তাহলে ছোটরাও আপনার দেখাদেখি নিজেদের পরিষ্কার রাখবে, ভাল থাকবে।