করোনাভাইরাস পরীক্ষায় ভুল হওয়ার আশঙ্কা কতটা? 

করোনাভাইরাস পরীক্ষায় ভুল হওয়ার আশঙ্কা কতটা? 

বাংলাদেশের আলো ডেস্ক: করোনাভাইরাসে বিশ্বব্যাপী যে পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে সেটায় শতভাগ নিশ্চিত ফলাফল পাওয়া যায় না। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী বার বার টেস্ট করার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশে যেখানে বারবার টেস্ট করার সুযোগ সীমিত সেখানে টেস্টের এই ভুল ফলাফলের একটা বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি ঢাকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এক বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা মারা যান।

তিনি বেশ কিছুদিন ধরে জ্বর ও কাশিতে ভোগায় চিকিৎসকের পরামর্শে তার নমুনা পরীক্ষা করিয়েছিলেন।

কিন্তু পর পর দুইবারের পরীক্ষাতেই ফলাফল এসেছিল নেগেটিভ।

কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হওয়ায় পরে তাকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সেখানে তৃতীয় দফায় তার নমুনা পরীক্ষায় জানা যায় তিনি আসলে করোনাভাইরাস পজিটিভ। এ রকম উদাহরণ কম নেই।

৩০% ভুল হতে পারে
করোনাভাইরাস পরীক্ষায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও "আরটি-পিসিআর" পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

এ ধরণের পরীক্ষায় কখনও শতভাগ নিশ্চিত ফলাফল পাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ আরিফুল বাশার।

তার মতে "আরটি-পিসিআর" পদ্ধতিতে ৩০% ফলাফল ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের দেশগুলোয় ম্যাস টেস্টিং এবং একজন ব্যক্তিকে বার বার টেস্ট করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই সুযোগ সীমিত।

পরীক্ষার ফলাফল কেন ভুল হয়
নমুনা পরীক্ষার এই ফলাফল কতোটা নির্ভুল আসে তার অনেকটাই নির্ভর করে কিভাবে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে, কিভাবে সেটা পরিবহন ও সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং কোন ল্যাবে সেটা পরীক্ষা করা হচ্ছে তার ওপর।

মি. বাশার বলেন, কিছু রোগীর ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস লক্ষণ খুব হালকা হতে পারে। অনেক সময় কোন লক্ষণই থাকে না।

এ ধরণের রোগীর শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কম থাকে। যখন তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয় তখন অনেক সময় তাদের শরীরে থাকা ভাইরাস ওই নমুনায় উঠে আসে না।

আবার নমুনা কোথা থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। নাক থেকে, গলা থেকে নাকি ফুসফুস থেকে সেটার ওপরও এই ফলাফলের নিশ্চয়তা নির্ভর করে।

সাধারণত গলা থেকে নেয়া নমুনায় ভুল হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। অনেক সময় তাড়াহুড়া করে নমুনা সংগ্রহ করলেও ভুল হতে পারে।

ফুসফুস থেকে নেয়া নমুনা পরীক্ষায় প্রায় শতভাগ নিশ্চিত ফল পাওয়া গেলেও, এই নমুনা সংগ্রহ করা যায় একমাত্র তখন, যখন রোগী লাইফ সাপোর্টে থাকেন।

এছাড়া সঠিক নিয়মে সঠিক তাপমাত্রায় নমুনাগুলো পরিবহন ও সংরক্ষণ করা হচ্ছে কিনা, এমন নানা বিষয়ের ওপর নমুনা পরীক্ষার ফলাফল ভুল আসতে পারে বলে জানিয়েছেন মি. বাশার।

দক্ষ জনবল, আধুনিক ল্যাবরেটরির অভাব
করোনাভাইরাসের এই নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে রিপোর্ট প্রস্তুত করা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় দক্ষ জনবলের প্রয়োজন, সেইসঙ্গে প্রয়োজন আধুনিক ল্যাবরেটরির।

নতুন করে মানসম্মত ল্যাব প্রতিষ্ঠা এবং টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দেয়ার মতো যথেষ্ট সময় বাংলাদেশ পায়নি বলে জানিয়েছেন জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট আইইডিসিআর-এর ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান তাহমিনা শিরিন।

তিনি জানান বাংলাদেশে নতুন করে যে ল্যাবগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেগুলোয় আগে পিসিআরে পরীক্ষা হয়নি।

তাই সেখানে প্রশিক্ষিত জনবলও স্বাভাবিকভাবে কম।

এছাড়া ল্যাবগুলো যে মানের হওয়া প্রয়োজন যেমন: তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সুব্যবস্থা, কঠোরভাবে মানুষের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র যেমন বাষ্প স্টেরিলাইজার বা অটোক্লেভ মেশিন, ক্যালিব্রেটেড বায়োসেফটি হুড, ইত্যাদি সুবিধা নতুন ল্যাবগুলোয় নেই বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, এই ল্যাবের কাজে যারা যুক্ত থাকেন অর্থাৎ ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট থেকে ল্যাব প্রধান পর্যন্ত সবার যে প্রটোকল মেনে চলা দরকার সেটা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়, যেহেতু যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই।

খুব দ্রুত প্রশিক্ষণ দিয়ে যেসব ল্যাব সম্প্রতি প্রস্তুত করা হয়েছে সেগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিমালা কতটুকু মেনে চলছে সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

এজন্য নিবিড় প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে তাহমিনা শিরিন জানান।

"প্রশিক্ষণের কোন ঘাটতি নেই"
তবে, স্বাস্থ্য অধিদফতর শুরু থেকেই জানিয়ে আসছে যে তারা দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে টেস্টিং কিটও তাদের কাছে আছে।

বাংলাদেশের বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যেসব স্বাস্থ্যকর্মী বর্তমানে নমুনা সংগ্রহের সঙ্গে জড়িত তারা আগে থেকেই দক্ষ বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের কর্মকর্তা মাহবুবা জামিল।

তিনি জানান, এই স্বাস্থ্যকর্মীরা আগে থেকেই ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম, পোলিও ইত্যাদি নানা রোগের নমুনা সংগ্রহের সাথে যুক্ত ছিলেন। যেটা করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের সঙ্গে মিলে যায়।

প্রতি বছর তাদের স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিডিসি বিভাগের মাধ্যমেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলেও তিনি জানান।

কিন্তু করোনাভাইরাস যেহেতু সংক্রামক ব্যাধি এজন্য তাদেরকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার বিষয়ে অনলাইনে বাড়তি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

মিসেস জামিল বলেন, "যখন বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলো তখন জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট একটি অনলাইন কোর্স করে এবং এ সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রস্তুত করে। এরপর সারা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর কয়েকটি মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজিস্ট এবং ভাইরোলজিস্টরাও ট্রেনিং দেন। এছাড়া তারা প্রতিবছর সিডিসি থেকে ট্রেনিং পেয়ে থাকে। প্রশিক্ষণের কোথাও ঘাটতি নেই," ।

বাংলাদেশে পোলিও বা হামের নমুনা যেভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিমালা অনুযায়ী পরিবহন করা হয় ঠিক একই নিয়মে করোনাভাইরাসের নমুনাও পরিবহন করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

তবে একজন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত কিনা সেটা নিশ্চিত হতে দেশব্যাপী ম্যাস টেস্টিং শুরু করা এবং একজনকে বারবার পরীক্ষা করার কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তার আগ পর্যন্ত তারা মানুষকে নিরাপদ থাকতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।-সূত্র: বিবিসি